সোমবার থেকে থেকে এ দেশে বুস্টার ডোজের ঢাকে কাঠি পড়ে গিয়েছে। যাঁদের বয়স ৬০-এর উপরে, যাঁদের অন্য কোনও গুরুতর অসুখ রয়েছে, এবং স্বাস্থ্যকর্মী-ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার যাঁরা, তাঁরাই এখন বুস্টারের বল পাচ্ছেন। প্রথম দিন রাত ৮টা পর্যন্ত ১০ লক্ষ এই ডোজ দেওয়া হয়। পাবেন মোট ৫ কোটি ৭৫ লক্ষ। এর মধ্যে ২ কোটি ৭৫ লক্ষের বয়স ৬০-এর উপর এবং এক কোটি স্বাস্থ্যকর্মী, ২ কোটি ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার্স। মূল কোর্সে প্রধানত কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিন-- এই দুটি দেওয়া হচ্ছে এ দেশে। বুস্টারেও এই দুটিই দেওয়া যাবে, যাঁরা যা নিয়েছেন মূলে, তৃতীয়-তে সেই ভ্যাকসিন পাবেন। দুই ভ্যাকসিনের মিশ্রণ হবে না। রবিবার পর্যন্ত ৬৩ কোটির বেশি ভারতীয় দুটি ডোজ পেয়েছেন, আর দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি ডোজ।
বুস্টার কেন দেওয়া হচ্ছে?
দুই সুচ ফোটানোর ফলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পায়। মানে করোনার বিরুদ্ধে দেহে যে প্রতিরোধশক্তি তৈরি হচ্ছে, তাতে ধাক্কা লাগছে কিছু সময়ের পর। এমনটাই বিভিন্ন গবেষণা থেকে সামনে এসেছে। এও দেখা যাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমনকি টি-সেল মেমোরি থেকেও ভ্যাকসিনের প্রতিরক্ষা-ছাপ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। বুস্টার ডোজের ফলে নতুন করে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে অ্যান্টিবডির জন্ম হচ্ছে শরীরে। অ্যান্টিবডির নবীকরণ বললেও ভুল কিছু হয় না। স্মলপক্স রুখতে আগে প্রতি তিন কিংবা পাঁচ বছর অন্তর দেওয়া হত বুস্টার। অন্তঃসত্ত্বা এবং বড়দের টিটেনাস দেওয়ার কথা এখন বলা হচ্ছে। শৈশবে তা নেওয়া সত্ত্বেও। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ এবং ব্রিটেনের মেডিসিন অ্যান্ড হেলথকেয়ার রেগুলেটরি এজেন্সি বা এমএইচডিএ বুস্টার ডোজে ছাড়পত্র দিয়েছে, জোরকদমে দেওয়াও চলছে ওই দুই দেশে। আরও বেশ কয়েকটি দেশে বুস্টার এগিয়েছে অনেকটা। কোথাও আবার চতুর্থ ডোজও শুরু হয়েছে।
কোভ্যাক্সিনের নির্মাতা ভারত বায়োটেক গবেষণা-লব্ধ তথ্য উল্লেখ করে জানিয়েছে, কোভ্যাক্সিন দেওয়ার ছ'মাস পর বুস্টার দিলে করোনার প্রতিরোধে টি-সেল এবং বি-সেল প্রতিক্রিয়া ঠিক মাত্রায় থাকে, এবং গুরুতর কোভিডে ভোগার সম্ভাবনা কমে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য।
ভ্যাকসিনে মিশ্রণ কেন হচ্ছে না?
নামী ভ্যাকসিনোলজিস্ট গগনদীপ কঙ্গ বলছেন, ভ্যাকসিনের যে তথ্য এসে পৌঁছেছে, তার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হচ্ছে বুস্টার। এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন মিশ্রণে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য এসে পৌঁছয়নি হাতে। কঙ্গ বলেন,'জরুরি ভিত্তিতে এই ভ্য়াকসিনের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। যাকে বলে ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন (EUA)। এর মানে হল, এটা পুরোপুরি লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়।' ভ্যাকসিনের দুনিয়ায় এমনটা এই প্রথম হচ্ছে, তা মোটেই নয়। উদাহরণ রয়েছে ছড়ানো-ছিটানো। বলছেন কঙ্গ। তাঁর কথায়, 'জরুরি পরিস্থিতির কথা কথায় রেখে বুস্টার ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, এখন ভ্যাকসিনের মিশ্রণ ঘটলে শরীরে যদি কোনও সমস্যা তৈরি হয়, তার দায় কে নেবে!' ভাইরোলজিস্ট ডা. ভি রবি বলছেন, 'দেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মূল ব্যাপারটা হল মেমোরি। মূল কোর্স যে ভ্যাকসিনের হয়েছে, তারই যদি বুস্টার দেওয়া হয়, তবে কোষের স্মৃতিকে উজ্জীবিত করা সহজ হতে পারে। সাড়া মিলতে পারে দ্রুত।'
প্রতিষেধকের মিশ্রণের ব্যাপারে কী গবেষণা?
কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাক্সিনের মিশ্রণ নিয়ে কোনও কোনও স্পষ্ট তথ্য বা তথ্যভাণ্ডার নেই আমাদের দেশে। তবে এ নিয়ে যে গবেষণা হয়নি, তা নয়। দুই ভ্যাকসিন মেশানোটা কি সুরক্ষার সঙ্গে সমঝোতা, সেই প্রশ্ন থেকে গবেষণা করেছে এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোএন্টোলজি (AIG)। তারা এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির মাত্রাও পরখ করে দেখেছে। এবং জানিয়েছে, ভ্যাকসিনের মিশ্রণে সুরক্ষায় কোনও সমস্যা হচ্ছে না। কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাও ভাল তৈরি হচ্ছে। এআইজি হসপিটালের চেয়ারম্যান ডা. নাগেশ্বর রেড্ডি বলছেন, 'এক ভ্যাকসিনের চেয়ে মিশ্র ভ্যাকসিনে দেহের প্রতিরোধ আরও ভাল তৈরি হচ্ছে। এ সংক্রান্ত তথ্য আইসিএমআর-কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।' ভ্যাকসিনের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনেক বিশেষজ্ঞই ভ্যাকসিন মিশ্রণের কথা বলছেন। ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজও এ নিয়ে গবেষণা করেছে। আগামী মাসে তার ফলাফল জানা যাবে।
আরও পড়ুন করোনা মুক্তির পথটা কি অনন্ত বুস্টার ডোজে, নাকি মুক্তির উপায় এখনও অন্ধকারে?
ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন বা হু-র মতে, এক ভ্যাকসিনে দেওয়া হচ্ছে সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে। এবং রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে যে তথ্য হাতে রয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ECDC)বলেছে, বুস্টারে ভ্যাকসিনের মিশ্রণ নীতি বিকল্প হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। ভ্যাকসিনের জোগান এবং প্রতিরোধ বৃদ্ধির কথা ভেবে হাঁটা যেতে পারে এই পথে। আইসিএমআরের ন্যাশনাল কোভিড টাস্ক ফোর্সের সদস্য সঞ্জয় পুজারী অবশ্য বলছেন, এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য দরকার আরও তথ্য। কারণ রোগ প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পুরোপুরি সুরক্ষার, ভ্যাকসিন মিশ্রণের নিরিখে যা এখনও অস্পষ্ট।
বুস্টার আরও বাড়ুক, আরও…। চাইছে সারা দেশ। চলছে তৃতীয় সুচের জন্য অধীর অপেক্ষা। ওমিক্রনকে হারাতে বুস্টারের পথে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় বা কি!