Advertisment

Explained: মনুস্মৃতির মেয়েরা ‘শূদ্র’, সমালোচনায় উপাচার্য, মনুসংহিতা কী, জানেন?

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তিশ্রী ধুলিপুডি পণ্ডিত সম্প্রতি মনুস্মৃতি-র সমালোচনা করেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
manusmriti controversy, Santishree Dhulipudi Pandit jnu vc speech, manusmriti controversy, indian express

মনুর বিধান হল মনুস্মৃতি। যাকে মনুসংহিতাও বলে।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তিশ্রী ধুলিপুডি পণ্ডিত সম্প্রতি মনুস্মৃতি-র সমালোচনা করেছেন। মনুস্মৃতিকে নতুন করে লিঙ্গ বৈষম্যের কাঠগড়ায় তুলেছেন উপাচার্য। উপলক্ষ বি আর আম্বেদকর বক্তৃতা। আয়োজন করেছিল কেন্দ্রীয় ন্যায়বিচার এবং ক্ষমতায়ন মন্ত্রক। সোমবার, ২২ অগস্ট, তাতেই পণ্ডিত বলেন, মনুস্মৃতি সমস্ত মেয়েদের শূদ্রের স্তরে নামিয়েছে। যা খুবই অবমাননাকর। পাশাপাশি, রাজস্থানে জলের পাত্র স্পর্শের ‘অপরাধে’ এক কিশোরকে শিক্ষকের মারধর, এবং তার জেরে ছেলেটির মৃত্যুর প্রসঙ্গও বক্তৃতায় তোলেন উপাচার্য। আম্বেদকরের মতাদর্শ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘যদি সমাজ ভাল কিছু করতে চায়, তা হলে জাতপাতের বিনাশ অত্যন্ত প্রয়োজন। কেন নিজেদের সেই আত্মপরিচয় নিয়ে এমন আবেগপ্রবণ হব আমরা, যা খুবই বৈষম্যমূলক। এমনকি যে কৃত্রিম আত্মপরিচয় রক্ষায় আমরা কাউকে খুন পর্যন্ত করতে তৈরি।’

Advertisment

মনুস্মৃতি কী?

মনুর বিধান হল মনুস্মৃতি। যাকে মনুসংহিতাও বলে। অনেকে মনে করেন, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টের জন্মের তৃতীয় শতকের মধ্যে এটি লেখা হয়েছে। যদিও কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটি সংস্কৃত শ্লোক সমগ্র। রচনাকার প্রসঙ্গেও নানা মুনির নানা মত। ভারতবিদ প্যাট্রিক অলিভেলের যুক্তি, ‘যে ভাবে একই রকমের কাঠামোয় সমস্ত শ্লোক লেখা হয়েছে, তাতে মনে হয় কোনও এক জন এইগুলি লিখেছেন। তিনি অবশ্যই প্রতিভাধর। হতে পারে লেখক কোনও একটি গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন, নানা জনের সহায়তায় রচনাকার্যটি করেছেন।’ সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত পৌরাণিক অভিধান কী বলছে মনু সম্পর্কে? মনু ‘ব্রহ্মার দেহ হতে উদ্ভূত। এর জন্য এঁর নাম ‘স্বায়ম্ভুব’ মনু। এঁর স্ত্রী শতরূপা, পুত্র প্রিয়ব্রত ও উত্থানপাদ, কন্যা আকুতি, দেবাহুতি ও প্রসূতি। এঁর পুত্র কন্যা হতে মনুষ্য জাতির বিস্তার, তাই তাঁরা মানব। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি—এই চার যুগের সহস্র যুগে (অর্থাৎ সর্বমোট চার সহস্র যুগে) ভগবান ব্রহ্মার এক দিন। ওই এক ব্রহ্ম দিবসে চতুর্দশ জন মনু জন্মগ্রহণ করেন।…’

আর মনুসংহিতা সম্পর্কে ওই বইটি বলছে, ‘মানবধর্মশাস্ত্র। হিন্দু ধর্মের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলি, হিন্দু-জাতির আচার, ব্যবহার ও ক্রিয়াকলাপের যথাকর্তব্য নির্ধারণ করে যে সংহিতা গ্রথিত হয়েছে, তা মনুর দ্বারা সংকলিত। প্রবাদ আছে, ইহা প্রথম মনু স্বায়ম্ভুব কর্তৃক লিখিত হয়।… এই সংহিতাকে হিন্দু আইনের ভিত্তি স্বরূপ বলা হয়।… কথিত আছে, সর্বপ্রথম এতে এক লক্ষ শ্লোক ছিল, কিন্তু এখন মাত্র ২,৬৮৪টি শ্লোক পাওয়া যায়।’

সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে জীবনযাপন আচারবিচারে কী করব কী করব না, তার অনুপুঙ্খ বয়ান লেখা রয়েছে মনুস্মৃতিতে। অলিভেলের বক্তব্য অনুযায়ী, মনুসংহিতার নির্ধারিত সমাজ রাজার শাসনে, ব্রাহ্মণের উপদেশে চলে। সেই সমাজের কাঠামোটা কী, তাই লেখা এই বইটিতে।

এর গুরুত্ব কী?

গবেষকদের অনেকেরই মতে, খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী কয়েক শতকে সনাতনী হিন্দুধারার চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছিল এই মনুস্মৃতি। কী করতে হবে, কী করা গর্হিত অপরাধ, যা এর পাতায় পাতায় লিখিত, মানতেই হত। না হলে সমাজে ব্রাত্য হয়ে যেতে হত। এমনকি পরবর্তীতে ইংরেজরাও এটিতে নিদারুণ গুরুত্ব দিয়েছে। এটিই প্রথম সংস্কৃত ভাষ্য যা ইউরোপীয় কোনও ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।

অনুবাদ প্রসঙ্গে

মনুসংহিতা ১৭৯৪ সালে অনুবাদ করেন ব্রিটিশ দার্শনিক স্যর উইলিয়াম জোন্স। এর পর ফরাসি, জার্মান, পর্তুগিজ, রুশ-- নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ম্যাক্স ম্যুলারের অনুবাদও রয়েছে এর মধ্যে: স্যাক্রেড বুকস অফ দ্য ইস্ট (১৮৮৬)। অলিভেল বলেছেন, ‘১৭৭২ সালে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সিদ্ধান্ত নেন, কোনও রকম বদল না ঘটিয়েই হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মীয় আইনকে তৃণমূল স্তর থেকেই প্রত্তন করবেন। স্বাভাবিক ভাবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে মনুস্মৃতিই প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে। কারণ ব্রিটিশরা এই বইটিকে আইন বলে মনে করত।…’

মনুসংহিতায় বিতর্ক

এই পুস্তকটি বিতর্কে ভরা। নানা মহল থেকে এটির তীব্র নিন্দা করা হয়েছে নানা সময়ে। এই পুস্তক অনুযায়ী, সমাজের সবচেয়ে নীচের তলায় স্থান শূদ্রদের। যাদের কাজ হল বাকিদের পরিচর্যা করা। শূদ্রের পাশাপাশি নারীর প্রতিও বৈষম্য রয়েছে এই গ্রন্থের নানা শ্লোকে। কয়েকটি শ্লোক তুলে ধরলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেমন, অষ্টম অধ্যায়ের ১২ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, যে রাজার রাজ্যে শূদ্র ধর্মবিষয়ক বিচার করে, সে রাজ্য পাঁকে পড়ে যাওয়া গরুর মতোই ডুবে যায়। যে রাজ্যে শূদ্রের সংখ্যা অনেক এবং বহু নাস্তিক বাস করেন, সে রাজ্য দুর্ভিক্ষ, রোগে শেষ হয়ে যায়। আবার, ওই অধ্যায়েরই ১২৯ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, শূদ্র অর্থবান হতে পারবেন না, কারণ তেমনটা হলে তাঁদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণরা উৎপীড়িত হবেন।

আরও পড়ুন Explained: মঞ্চে আম্বানি-আদানিরা, কীভাবে রায়দের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে এনডিটিভির কর্তৃত্ব

অষ্টম অধ্যায়ের ৩৭১ নম্বর শ্লোক বলছে, যদি কোনও নারী তাঁর স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত হন, তা হলে রাজার উচিত চার মাথার মোড়ে সেই নারীর উপর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া। পঞ্চম অধ্যায়ের ১৪৮ নম্বর শ্লোক বলছে, শিশু অবস্থায় কোনও মেয়ে তার বাবার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, বিবাহের পর স্ত্রী হিসেবে তাঁর স্বামীর নিয়ন্ত্রণে, স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। বলা হয়েছে, নারীর স্বাধীন ভাবে জীবনযাপনের কোনও অধিকারই নেই। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৩ নম্বর স্লোক বলছে, পুরুষকে নষ্ট করে দেওয়াই মেয়েদের স্বভাব। সেই মতো কোনও বিচক্ষণ পুরুষ নারীর প্রলোভনে কখনওই পা দেন না।

নানা পরতে বৈষম্যের বার্তাবহ এই বইটিকে পরিত্যজ্য বলে মনে করেছেন বাবাসাহেব বি আর আম্বেদকর। তিনি ২৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মনুস্মৃতি জ্বালিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। অনেক পরে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধও হয়ে যান।

JNU Manusmriti
Advertisment