তালিবানের গ্রাসে কাবুল চলে যাওয়ায় দেশ ছেড়ে, প্রেসিডেন্টের খেতাব কোনও ক্রমে ছুড়ে পগারপার আশরফ ঘানি। বলতে চেয়েছেন, দেশ আঁকড়ে থাকলে সাধের প্রাণটা তো চলেই যেত! সোজা কথা, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! রামনাম সত্য হ্যায়, গুলাব জামুন মস্ত হ্যায়-- কে আর বলতে চায় গো! তা এখন অভাগা আফগানিস্তানের কী হবে? কখনও কি তালিবানের পিঞ্জর থেকে মুক্তি মিলবে আফগানমাতার? এখনও টিমটিমে, তবুও আলো দেখাচ্ছেন আহমেদ মাসুদ নামে এক যুবা। চেনেন মাসুদভাইকে? তিনি পঞ্জশির উপত্যকার 'শের' আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে। তাঁকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়, কারণ বাপের চেহারার সঙ্গে তাঁর বড় মিল, চালচলনও অবিকল তাঁর মতো।
১৯৮০ নাগাদ সোভিয়েত বিরোধী ঝড় হয়ে উঠেছিলেন শাহ। তার পর তালিবান, আল-কায়দার বিরুদ্ধেও খড়গ তাঁর উদ্যত হয়ে ওঠে। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। তালিবান ও আল-কায়দার ছকে খুন হয়ে যান শাহজি। ছেলে এখন তাঁরই কামানে গোলা ভরছেন। পঞ্জশির তালিবানের হাতের মোয়া যে হয়নি এখনও, তাঁর প্রতিরোধেই। এই উপত্যকা দখলের লক্ষ্যে তালিবান অবশ্য মরিয়া। ঘিরে ধরেছে, পাহাড়ি পথে তীব্র বাধা টপকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় জঙ্গিরা, ঘোর যুদ্ধকাল।
বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া… সবটা আছে কি না অজানা, তবে বাপের গুণ অনেকটাই রয়েছে মাসুদের মধ্যে। আর সেটাই আফগানবাসীর আশার পাঁচ। তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক তাঁর-- চুম্বক-গর্জন। ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট অফ আফগানিস্তান বা আফগানিস্তানের জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্টের নেতৃত্বের রশি তাঁর হাতেই যে! আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লা সালেহ শুরুতেই তাঁর টিমে, দু'জনের বৈঠক বার বার, তাতে তালিবানের বিরুদ্ধে রামদা সাইজের চ্যালেঞ্জ কী করে ছোঁড়া যাবে, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা। মাসুদের কথাবার্তাও কিন্তু বেশ আধুনিকতায় চোবানো।
আরও পড়ুন বাড়ছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান, সে দেশ আবার কি রক্তে ভাসবে?
যেমন তিনি বললেন, 'আফগানদের জন্য তালিবান সমস্যা তৈরি করবে না শুধু, তালিবানের শাসনে মৌলবাদী ইসলামিক সন্ত্রাসের গ্রাউন্ড জিরো হয়ে উঠবে তাঁর দেশ। আফগানিস্তানকে গণতন্ত্রশূন্য উসর ভূমি করে তোলাই তালিবানের লক্ষ্য।' জোট বাঁধো তৈরি হও, তালিবান বিরোধী সব শক্তির উদ্দেশে তাঁর ডাকে তাই সারা দেশে সাড়া। ফরাসি দার্শনিক বার্নার্ড-হেনরি লেভিকে ক্রোধকাতর দু'চোখে জানিয়েছেন, 'প্রতিরোধের দিন জোরকদমে। কারণ, আত্মসমর্পণ তাঁর অভিধানে নেই।' ফিরে যাচ্ছেন ছেলেবেলাতেও। ১৯৯৮ সালে, পঞ্জশিরের গুহায় তাঁর বাবা সেনা জড়ো করেছেন তখন, তাঁর বয়স মাত্র নয়। 'যখন তুমি তোমার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছ, তখন তুমি আমাদের সকলের স্বাধীনতার জন্যও লড়ছ।' তাত্ত্বিক মন্তব্য এই টগবগানো যুবার।
পাশ্চাত্যের কাছ থেকে তালিবান-রোধী লড়াইয়ের জন্য সাহায্য চাইছেন মাসুদ। যেন বলছেন, 'তোমরা আমায় আস্ত্র দাও আফগানিস্তানকে স্বাধীনতা করে দেবো আমি।' বলছেন, 'আমরা মুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। যে সমাজে একটি মেয়েও চিকিৎসক হতে পারবেন। সংবাদমাধ্যম স্বাধীন, বন্ধনহীন হবে। সেই দেশে স্টেডিয়ামগুলিতে বসে গণনিধন দেখা হবে না-- ফুটবল ম্যাচ দেখবেন তরুণতরুণীরা, গান গাইতে গাইতে মনের সুখে তাঁরা নাচতে পারবেন সেখানে, দলবদ্ধ নাচ।… হ্যাঁ, হবে-- আসবেই সেই দিনগুলি।' নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে… এই তাঁর কথা। জয় করব, করবই, এই তাঁর জেদ। দু'বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না, এই তাঁর দেহ-তরঙ্গ। গেরিলা যুদ্ধ… হারে রে-রে হাল্লাদের তাঁরা কিছুতে ছাড়বেন না।
পঞ্জশির, এই যুবকের শাসনক্ষেত্র, আফগানিস্তানের সবচেয়ে সুরক্ষিত ভূমি, তালিবানের হাতের নাগালের বাইরের তপোবন, অভয়ক্ষেত্র। অন্তত এই মুহূর্তেও। পশতু ভাষায় পঞ্জশিরের ঠিক উচ্চারণটা পঞ্জশের। শের মানে সিংহ। পঞ্জশের-- পাঁচটা সিংহ। আফগানিস্তানের চৌত্রিশটি রাজ্যের মধ্যে একটি। আফগান দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ (কাবুলের ১৫০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে)। এর উত্তরে বাঘলান এবং তাখর। পূর্বে বাদখশান, নুরিস্তান। দক্ষিণে লাঘমান এবং কাপিসা, পশ্চিমে পারওয়ান। পাহাড়ে ঘেরা এক শান্ত ও সুশৃঙ্খল জনপদ। ৫১২টি গ্রাম, ঠিকরানো পার্বত্যপ্রকৃতি। ২০২১-এর হিসেবে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৭৩ হাজার। শিক্ষিতের হার মন্দ নয়, কাছাকাছি ৪০ শতাংশ। রাজধানী বাজারাক। স্বাধীনতার অক্সিজেনে ডোবা। বরাবর।
আরও পড়ুন তালিবান: এক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও নৈরাজ্যের পত্তন
সোভিয়েতের কমিউনিস্টদের দখলদারির বিরুদ্ধে সিনাটান লড়াই যেমন, মুজাহিদিনদের এক অংশের যে মহা-নৈরাজ্য রোখা। তার পর তালিবান। মৌলবাদী এই জঙ্গি দলের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার। যেন সিংহে সওয়ার হলেন শাহ। ব্যর্থ তালিবান শক্তি। কিন্তু বেশি দিন বাঁচলেন না। ২০০১-এর ৯ নভেম্বর। শাহ মাসুদের খুনিরা সাক্ষাৎকারীর বেশে এসেছিল। ইন্টারভিউয়ের সময় ক্যামেরা এবং ব্যাটারিতে লুকিয়ে থাকা বোমা বিস্ফোরণে নিহত এই আফগান হিরো।
হিন্দুকুশ পর্বমালার ভিতরে পঞ্জশির যেন লুকানো, পৌঁছানো কঠিন, দখল আরও কঠিন, তবুও তালিবান এগচ্ছে। দাঁতনখ সব বেরিয়ে এসেছে। মাসুদ পারবেন। নিশ্চয় পারবেন। বাবার খুনের বদলা, দেশকে বাঁচানো-- দুই লক্ষ্যই এক বিন্দুতে। পারতেই হবে। দুনিয়ার তালিবান বিরোধীরা এই আশায় অন্তরের প্রদীপ জ্বালিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে বসে। আমেরিকা কি ঘুমোচ্ছে?