ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে বুচা-য় পৌঁছতে গাড়িতে আধ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে। মানে, একেবারে রাজধানীর উপকণ্ঠ বলতে যা বোঝায় বুচা তা-ই। ইউক্রেনের কণ্ঠরোধে সেখানেই গণহত্যা চালিয়েছে রুশ ফৌজ, যার ছবি সারা পৃথিবী দেখে স্তম্ভিত। উপগ্রহচিত্রে দেখা গিয়েছে ৪৫ ফুট লম্বা গণকবর। পিছমোড়া করে বাঁধা বহু সৈন্যের দেহ ছড়ানো পথে। বুচা-র মেয়র জানিয়েছেন, তিনশোরও বেশি স্থানীয় বাসিন্দাকে হত্যা করেছে রাশিয়ার সেনা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি একে সন্ত্রাসবাদী হামলা বলেছেন। আমেরিকা এই ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ বলেছে। এবং ভারত বুচা-গণহত্যার রাকঢাক না করেই নিন্দা করেছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট না দিলেও, ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সবচেয়ে কট্টর রুশ-সমালোচনা শোনা গিয়েছে এ দেশের গলায়। মঙ্গলবার রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধি টিএস তিরুমূর্তি মানবিকতার প্রশ্ন তুলে এই বর্বরতার কড়া নিন্দা করেন। পাশাপাশি, প্রশ্ন উঠেছে, এই ভয়ঙ্কর, পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কি আরও কঠোর সুরে বাঁধবে না ইউরোপ? কিন্তু এটা কি সম্ভব, এটা সহজ কাজ?
গ্যাস-তেলে রুশ নির্ভরতা
রাশিয়ায় বিপুল তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার। প্রতি দিন ইউরোপের আমদানিকারী বিভিন্ন সংস্থা যা আমদানিতে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে থাকে। মানে ইউরোপ রাশিয়ার তেল-গ্যাসের উপর রীতিমতো নির্ভর। ফলে এই সাপ্লাই লাইনটা পুরো বা অনেকটা এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে আংশিক কেটে দেওয়া একেবারেই সহজ নয়। আসুন, গ্যাস-তেলের রুশ নির্ভরশীলতার ছবিটা দেখে নিই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি তাদের মোট গ্যাস আমদানির ৪৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে আনে। তাদের মোট গ্যাস খরচের যা ৪০ শতাংশ। তেলের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৬ শতাংশ আসে সেখান থেকে, এর মধ্যে ডিজেলের ১৪ শতাংশ রাশিয়ার। ফলে গোটা ইউরোপের সভ্যতার চলাচল অনেকটাই রাশিয়া-নির্ভর। শক্তিই তো সভ্যতার প্রাণস্পন্দন!
কেন আমেরিকা পারল ইউরোপ নয়?
আমেরিকা রাশিয়া থেকে কম পরিমাণে তেল আমদানি করত (মাত্র ৮ শতাংশ)। প্রাকৃতিক গ্যাস একেবারেই আমদানি করত না। মাটির অনেক গভীর থেকে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের যে প্রযুক্তি, যাকে ফ্র্যাকিং বলা হয়, তার সৌজন্যে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি তুলে আনছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে ১৯৪৭ সাল থেকে। ১৭ লক্ষ কূপ থেকে ৭০০ কোটি ব্যারেল এবং ৬০০ ট্রিলিয়ন বর্গফুট প্রাকৃতিক গ্যাস তোলা হয়েছে এই ভাবে। ফলে আমেরিকা নিজেই তেল ও গ্যাস দুটোই রফতানি করতে পারে। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে বাকি ইউরোপে তেল-গ্যাস উত্তোলন যে করে না, তা নয়। কিন্তু পরিমাণে তা কম। এতেই রুশ নির্ভরশীলতা বাড়ছে, এবং মহামারির পর সেটা আরও বেড়েছে। ইউরোপের বাকি দেশগুলি রাশিয়া থেকে ১৫৫ বিলিয়ন বর্গমিটার গ্যাস আমদানি করে, তার মধ্যে ১৪০ বিলিয়ন বর্গমিটার পৌঁছয় ইউক্রেন হয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে। এর মধ্যে লিক্যুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস, এলএনজি খুবই দামি। যার সাপ্লাই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এখন রাশিয়ার গ্যাস কাটছাঁট করলে শূন্যস্থান পূর্ণ হবে কী করে? স্পেনের মতো কয়েকটি দেশ এলএনজি-র টার্মিনালের মাধ্য়মে সংযুক্ত, এবং নতুন প্রকল্প তৈরি হয়েছে গ্রিস এবং পোল্যান্ডে।
আরও পড়ুন Explained: রাশিয়ার রোখ আরও বাড়াচ্ছে নেটোর শক্তি, কী ভাবে জানেন?
কিন্তু পরিকাঠামোগত সমস্যায় বাকি ইউরোপকে এলএনজি পাঠাতে তারা এখনও অপারগ। এখন রাশিয়াকে ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক বা কাছাকাছি স্বাভাবিক রাখতে হলে পাইপলাইন এবং টার্মিনাল তৈরি করতে হবে অনেক। কিন্তু তার জন্য সময় লাগবে যথেষ্ট। রাতারাতি তো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। তবে এর মধ্যেও অনেকে রাশিয়াকে 'না' বলতে পেরেছে। যেমন লিথুয়ানিয়া শনিবার বলেছে, তারা রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করবে না। তারা ২০১৪ সালে তৈরি একটি টার্মিনালের উপর নির্ভর করে যা করার করবে। পোল্যান্ডও বহু বছর ধরে বিকল্প পথের সন্ধান চালাচ্ছে, তারাও বলে দিয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস আমদানির যে চুক্তি রয়েছে এ বছরের পর তা আর রিনিউ করবে না। রাশিয়া থেকে কয়লা এবং তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও তারা জানিয়েছে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানি কী করছে? জার্মানি এখনও তার ৪০ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে।
এই গ্রীষ্মের মধ্যে তারা রাশিয়ার কয়লা আমদানি বন্ধ করতে চলেছে, এ বছরের শেষের মধ্যে তেল আমদানিও শেষ করবে বলে জানিয়েছে, গ্যাস আমদানি বন্ধ করা এতটা সহজ হবে না। জার্মানি এ ক্ষেত্রে ২০২৪ সালকে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার গ্যাস ২০৩০ সালের মধ্যে দুয়ের তিন ভাগ ছেঁটে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। সেই ঘাটতি পূরণে আমেরিকা, কাতার থেকে আরও গ্যাস তারা আনবে। নরওয়ে এবং আলজেরিয়া থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানি বাড়ানোর ভাবনা রয়েছে আরও অনেকটাই। তেলের বেশির ভাগটাই অবশ্য আসে জাহাজে। রাশিয়ার নির্ভরশীলতা পুরোপুরি শূন্য করে তোলা এ ক্ষেত্রেও সহজ হবে না। ইউরোপের বাজার থেকে রুশ তেল চলে গেলে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও বেড়ে যাবে। রাশিয়া ভারতকে বিকল্প হিসেবে তেল বিক্রি করতে চাইবে আরও। যদিও তাতে রাশিয়ার ক্ষতি হবে, কারণ কম দামে ভারতকে তেল বিক্রি করতে হচ্ছে, কিন্তু পুতিনের তো আর কিছু করার নেই।
আরও পড়ুন Explained: যুদ্ধের অস্ত্র কি মুদ্রা? পুতিনের মুদ্রা-সিদ্ধান্তে রাশিয়া কতটা ভুগবে?
রাশিয়ার গ্যাস-তেল পুরোপুরি বন্ধ হলে কী হবে?
এই রফতানি বন্ধে ইউরোপের অর্থনীতিতে প্রবল রক্তক্ষরণ হতে পারে। সাধারণ মানুষ বিস্তর সমস্যায় পড়বেন। প্রতিদিনের জীবন-জীবিকা নিদারুণ প্রভাবিত হতে পারে। সরকারকে রেশন করে বিভিন্ন সংস্থাকে গ্যাস-তেল দিতে হবে, যাতে জরুরি পরিষেবাগুলি অনর্গল থাকে। সার, রাসায়নিক পদার্থ, ধাতুর বাজারে এর কড়া প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। হাজারো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন এর জেরে।
ফলে রাশিয়াকে ব্যান করে দেওয়া বা একঘরে করে দেওয়ার মধ্যে সমাধান নেই। রাশিয়াকে শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেদের বিপদে ফেলা হচ্ছে এর ফলে। যার প্রভাব সুদূর প্রসারী। বলছেন অনেকেই। তাই আসল কাজটা হল, যুদ্ধটাকে থামানো। কিন্তু সেই পথও যে বড়ই বন্ধুর।