তালিবানের মেরুদণ্ড কারা? সারা পৃথিবীই হয়তো বলে উঠবে-- পাকিস্তান, পাকিস্তান, পাকিস্তান…। শব্দটার ইকো হবে হাহাকারের মতোই। কাবুল যখন দখল করল এই জঙ্গি দলটি, পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এর পাকা প্রমাণও দিলেন। বললেন, আফগানিস্তানে 'কৃতদাসত্বের শিকল ভাঙল'…। আসলে ভারতের সঙ্গে আফগান দেশের নিবিড় সম্পর্ক পাকিস্তানের কাছে বড় বিড়ম্বনা হয়ে উঠেছিল, ইন্ডিয়ার প্রশংসা বারে বারে করে যেত আফগান সরকার, সে দেশের পুনর্গঠনে এ দেশের অবদানের কাহিনি, পাকিস্তানের গায়ে জ্বালা ধরাত, কাবুল-পতন মানে ভারতকেই ধাক্কা দেওয়া-- বহু দিনের বন্ধু তালিবানকে দিয়ে সেই কাজটি করিয়ে নিল তারা, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার যা জলবৎ করে দিয়েছিল। এটাই সরল বিশ্লেষণ, কে না জানে?
পাকিস্তান সরকারের একাংশ তালিবানের বিরুদ্ধেও, কিন্তু সিংহ ভাগটাই এই জঙ্গি গোষ্ঠীকে হাতের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষে, ফলে তা-ই করে যাচ্ছেন ইমরান খান। আগুন নিয়ে খেলাটা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে, যারা আগুন নিয়ে খেলছে তারা এটা ভুলে যায়, ফলে হঠাৎ পুড়ে গিয়ে এক মুঠো ছাইও তারা হয়ে যেতে পারে! কী ভাবে? এই যে তালিবানের কাবুল দখল, তাতে পাকিস্তানে তালিবান জঙ্গিশক্তি তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি বাড় আরও বেড়ে উঠল যে! যাদের মূল লক্ষ্যই হল, পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করা। কাবুলে তালিবান-রাজের পর কয়েক শো টিটিপি জঙ্গি সে দেশের জেল থেকে মুক্ত। এদের মধ্যে রয়েছে মৌলভি ফকির মহম্মদ, টিটিপির প্রাক্তন ডেপুটি চিফ। মুক্তি পেয়েই তারা নিজেদের বাহিনীতে যোগ দিয়ে হামলার জন্য তাল ঠুকছে। টিটিপি-র তাত্ত্বিক শক্তি আল কায়দার বহু কম্যান্ডারও ছাড়া পেয়েছে আফগান জেল থেকে। দোঁহে মিলে কী খেলাটা এ বার হবে, সেই আশঙ্কা!
পাক-গর্ভে কী ভাবে তালিবানের জন্ম?
একটু অতীতে তলানো যাক। ১৯৮০ নাগাদ, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লক্ষ্যে ঢালাও অস্ত্র দিয়ে মুজাহিদিন এক দল যোদ্ধাকে তৈরি করল সিআইএ এবং আইএসআই। জিহাদের ঘুণপোকা নানা ইন্দ্রিয়-মাধ্যমে ঢোকানো হল তাদের মাথার ভিতর। এক আগ্রাসী বোধ ডানা মেলে উঠল। সারা পৃথিবী থেকেই জিহাদের লক্ষ্যে সেই দলে যোগ দিতে থাকল তরুণ তুর্কিরা। ১৯৮৮-তে ৩০ লক্ষ আফগান তরুণ রিফিউজিকে বিভিন্ন মাদ্রাসায় 'প্রকৃত শিক্ষা' দিতে শুরু করে তারা। ট্রেনিং শেষেই হাতে-গরম জিহাদি সার্টিফিকেট এবং তার পর তালিবান জঙ্গি মহাসংগঠনে চাকরি তো বাঁধা। এখানে ঝটিকি বলে নিতে হবে, তালিবান শব্দটি সম্পর্কে। তালিব শব্দ থেকে তালিবান এসেছে।
তালিব: পশতু ভাষায় অর্থ ধর্মীয় ছাত্র, তালিবান তালিবের বহু বচন। 'তালিবানরা' লেখা তাই উচিত নয়। যদিও শব্দটির ব্যঞ্জনা বেড়েছে অনেক গুণ, বচনের আওতা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তাই বলা হচ্ছে-- পাক তালিবান, কিংবা আমেরিকান তালিবান, এখানে পাক তালিব বা আমেরিকান তালিব বলা হচ্ছে না। কারণ, তালিব বললে তালিবান বোঝানো হয়তো যায় না সব সময়। যা হোক, ১৯৮৮ সালের পাকিস্তানের তালিবান স্কুলের কথা বলছিলাম। যেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ জঙ্গির জন্ম কিছু দিনেই। তার পর, সোভিয়েত আফগানিস্তান ছাড়লে সে দেশে ফিরে যায় পাকিস্তানের মাদ্রাসায় তৈরি হওয়া ১০ লক্ষ ৫০ হাজার যুবা জঙ্গি। নতুন এক জঙ্গি আন্দোলন, রক্তস্রোত ও জিহাদের স্বপ্নে বুক বেঁধে।
১৯৯২। সোভিয়েতের আশীর্বাদধন্য মহম্মদ নাজিবুল্লার সরকার ভেঙে ফেলে মুজাহিদিনরা। আফগানিস্তানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তারা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে শুরু থেকেই ক্ষমতা নিয়ে তৈরি হল প্রবল বিবাদ। মুজাহিদিন দলগুলি সরকার গঠনের লক্ষ্যে একটি চুক্তি করল, যার নাম-- পেশোয়ার অ্যাকর্ড। কিন্তু গুলবুদ্দিন হেকমতেয়ারের হেজাব-ই-ইসলামি গুলবুদ্দিন, হিজব-ই-ওয়াদত এবং ইদ্দিহাদ-ই-ইসলামি চুক্তিতে অংশ নিল না। আফগানিস্তানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হেকমতেয়ারের সেনা কাবুলে ঢুকে ধ্বসলীলা চালাতে থাকল। আইএসআই তাদের আর্থিক ও সেনা সাহায্য করল।
১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বর। মোল্লা মহম্মদ ওমরের নিজের শহর কান্দাহারে ৫০ জন মাদ্রাসা ছাত্রকে নিয়ে আর একটি দলের আনুষ্ঠানিক বিসমিল্লাহ হল। দুর্নীতি মুক্ত এবং প্রকৃত ইসলামসম্মত সমাজের ডাক দিল তারা। তাদের বলা হতে থাকল, তালিবান। পাকিস্তান ও আইএসআই সমর্থনের দু'বাহু বাড়িয়ে দিল তাদের দিকেও।
আরও পড়ুন তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের গলায়-গলায় দোস্তি, কী ভাবে?
২০০১ সাল। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো ঢুকল আফগানিস্তানে, তালিবানের পতন হল, অনেক নেতা-কর্মী পালিয়ে পাকিস্তানে পৌঁছল। পাক-আফগান সীমান্তে আদিবাসী আঞ্চলে তালিবান এবং আল কায়দার নেতারা এক সঙ্গে জমা হয়ে গেল। পুরো ক্ষীর যেন, নতুন করে আন্দোলনের বীজ পোঁতা হল। ২০০৩ পর্যন্ত এদের নিয়ে কী করিতে হইবে, পুরোটা ভেবে উঠতে পারল না পাকিস্তান সরকার।
এখানে বলে নিই, আইএসআইয়ের সঙ্গে তালিবানের গভীর সম্পর্ক বার বার সামনে এসে হাজির হয়েছে। একটি ঘটনা হল: ২০১৫ সালে তালিবানের উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। দলের দুই উপপ্রধানের একজন তিনি, দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এই হাক্কানি আইএসআইয়ের ডানহাত হিসেবেই পরিচিত ছিলেন (আবার আল কায়দার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন)। এখন পাক সরকারও কি তালিবানকে সমর্থন দিতে চেয়েছে সব সময়?
পাকিস্তান সরকারের অনেকেই তালিবানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন, রাখেনও। কিন্তু পাক সরকারের ব্যর্থতা হল এটাই-- পাক প্রধানমন্ত্রী এমনকি সেনাপ্রধানও যদি তালিবানের বিরুদ্ধে কালাশনিকভ নিয়ে মাঠে নামেন, তাও এই জঙ্গিসংগঠনটিকে সমর্থন করে যেতে আইএসআইয়ের কোনও সমস্যা নেই। তবে সেই সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না, বরং উল্টোটাই। তা-ই তো 'কৃতদাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত' আফগানিস্তানের গান গেয়েছেন ইমরান খান।
আরও পড়ুন তালিবান: এক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও নৈরাজ্যের পত্তন
কারা পাকিস্তান তালিবান
২০০১-এ আফগানিস্তানে নয়া সরকারের গঠন। পালিয়ে গিয়ে তালিবান এবং আল-কায়দা জঙ্গিদের অনেকেই মাথা গোঁজা পাক-আফগান সীমান্তে , অল্প আগেই বললাম যে কথাটা। এর পর কী হল? সীমান্তবর্তী আদিবাসী এলাকায় তালিবানিকরণ শুরু হল। আমেরিকা ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে আদাবাসীদের তালিবান করার প্রক্রিয়া। এরাই গঠন করল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান। ২০০৭ সালে। নেতা বায়তুল্লা মাসুদ। আদিবাসী এলাকায় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ছাতা হয়ে উঠল টিটিপি। টিটিপি-র লক্ষ্য তখন-- শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠা, এবং আমেরিকা-ন্যাটোর বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই। পরে, ২০০৭-এ টিটিপি-র শীর্ষ নেতা মাসুদের মুখপাত্র জানায়, পাক অপারেশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করাই টিটিপি তৈরির মূল কারণ। ইউএস ইনস্টিটিউট অফ পিস বা ইউএসআইপি-এর রিপোর্ট বলছে, অন্য বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া-পথে এগিয়ে চলতে থাকে টিটিপি।
তবে এর ছাতার তলায় থাকা বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে তালমিলের নিদারুণ অভাবটা বার বার সামনে এসে পড়ছিল, টিটিপি দুর্বল হয়ে পড়ে একটা সময়ে। ২০১১ মাঝামাঝি থেকে যেন এই জঙ্গিদলে নতুন এক জোয়ার এসে যায়। তাদের ২৫ হাজার সদস্য পাকিস্তান জুড়ে বিভিন্ন জঙ্গি হানা চালাতে থাকে। রক্তে ভেসে যেতে থাকে পাকিস্তান। ২০১১ সালের ২২-২৩ মে করাচিতে পাকিস্তান ন্যাভাল এয়ার আর্মের সদর দফতরে, ২০১৪ সালে করাচি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা হয়। ২০১৪-তেই পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে টিটিপির হামলায় নিহত ১৫০ জন, এঁদের বেশির ভাগই ছাত্র।
২০১৪ সালে আমেরিকান ড্রোনের সাহায্যে টিটিপির বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামে পাকিস্তান সেনা। টিটিপি নিকেশে চালানো হল 'অপারেশন জারব-ই-আজব'। ইউএসআইপি-র রিপোর্ট বলছে, এই অপারেশন সফল হয়েছিল অনেকটাই। টিটিপি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের নানা এলাকায় গিয়ে টিটিপির বহু নেতা গা-ঢাকা দিলেন।
কিন্তু… আবার সে এসেছে ফিরিয়া, এমনই বলছে নানা হামলার খবর, রিপোর্টও। খবর মিলেছে, টিটিপি জঙ্গিরা উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে গান শোনা ও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া মেয়েদের বাইরে বেরনোয় ফতোয়া জারি করেছে। ২০২০ সালে 'উমর মিডিয়া' নামে নতুন একটি ওয়েবসাইটও প্রকাশ করে এই জঙ্গি সংগঠনের সংবাদ শাখা। ২০২০-তে সেই উমর মিডিয়ার ঘোষণা: 'জামাত-উল-আহরার এবং হিজবুল আহরার নামে দুটি জঙ্গি দল টিটিপি-তে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিয়েছে'। এই দুটি দল পাকিস্তানে বহু সন্ত্রাসবাদী হামলার যুক্ত, এর ফলেই এই স্বাগত, সংযোগ। ২০২১-এর শুরু থেকে টিটিপির ওড়াউড়ি তো আরও বেড়েছে। বিভিন্ন হামলার খবরও এসেছে। এ বছরের প্রথম দু'মাসে সেই হামলার সংখ্যাটা অন্তত ৩২।
আরও পড়ুন নাজিবুল্লার মতো মরতে চাননি, তাই হয়তো পালিয়ে বাঁচলেন ঘানি!
টিটিপি-র সঙ্গে আফগানিস্তানের তালিবানের সম্পর্ক কেমন? সম্পর্কটা উত্থান-পতনের। বিভিন্ন সময় একে অপরকে সমর্থন করেছে এই দুই জঙ্গি দল। আবার বিরোধিতাও করেছে। যদিও এদের তাত্ত্বিক অবস্থানটা তো হুবহু এক, ফলে নাড়ির টান অপরিসীম। তালিবানের কাবুল পুনর্দখলের পর, আফগানিস্তানের জেল থেকে তাই একের পর টিটিপি জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে-- এ বার কী হবে? কারণ, টিটিপির মূল এজেন্ডাই পাকিস্তান সরকারকে ধ্বংস করা, এই লক্ষ্য ছেড়ে দিলে তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। আবার আফগান তালিবানের প্রধান সমর্থকই পাকিস্তান, তবে? টানাপোড়েন নবরূপে।
আর এই সব কিছু পেরিয়ে একটা কথা সকালের আলোর মতো সত্যি-- টিটিপি-র ক্ষমতা যে ভাবে গনগনিয়ে বাড়ায়, আম-পাকিস্তান নতুন করে রক্তপাতের খাদের কিনারায়। মানুষ তো উলুখাগড়া, কয়েকটা কমে গেলে ক্ষতি কি-- পাক সরকার নির্বিকার?