২০১৭ সালে ডোকালামে যখন চিনা সেনা প্রবেশ করল, সে সময়ে ভারতের তরফ থেকে ৬০ হাজার সেনা প্রবেশ করানো হয় সিকিম সীমান্তের চিন-ভারত-ভূটান সংযোগস্থলে।
১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে-র মধ্যে ভারতের তরফ থেকে আড়াই লক্ষ কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যকে ২৫টি হেলিকপ্টার, ৫০০-র বেশি ট্রেন, ১৭,৫০০ গাড়ি, শয়ে শয়ে ঘোড়া এবং খচ্চর এবং নৌকো ও জাহাজে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এর জন্য খরচ পড়বে ২০০ কোটি টাকারও বেশি। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে নির্বাচন নিরাপদে সংগঠিত করার ব্যয়ভার এটাই।
আরও পড়ুন, ইভিএম মেশিনে কীভাবে ভোট দেবেন জানেন ?
৯০ কোটি মানুষকে ৫৪৩ টি আসনের ১০ লক্ষ বুথে, ৩৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ভোটদানের বন্দোবস্ত করার জন্য প্রয়োজন যথাযথ সমন্বয়সাধন এবং ব্যতিক্রমী ক্ষমতা। ভারতের বৈচিত্র্য, জাতি এবং সম্প্রদায়গত বিভেদ এবং বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসের আশঙ্কা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন সংগঠিত করার দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন। দিন স্থির করা থেকে শুরু করে পুলিশ, ফৌজ, ভোটকর্মীদের ব্যবহার করার ব্যাপারে সমন্বয় পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব তাদের উপরেই ন্যস্ত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে নিরাপত্তা বাহিনীর যোগান দিয়ে থাকে এবং সেনাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রেলমন্ত্রক ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। নির্বাচনী কাজের জন্য সমস্ত ধরনের সেনাকর্মীদের মোতায়েন করা এবং তাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর ব্যাপারে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকে সিআরপিএফ।
সিআরপিএফের ডিজি আরআর ভাটনগর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, "লোকসভা ভোটের সময়ে প্রচির পরিমাণ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন পর্যায়ে ভোটের জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্ন রকম। নির্বাচন কমিশন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ মোতাবেক এই বাহিনীকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর জন্য ট্রেনের প্রয়োজন হয়, খাবারের প্রয়োজন হয়, এবং জওয়ানদের থাকার ব্যবস্থাও দরকারি হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও ওই নির্দিষ্ট জায়গা সম্পর্কে তাদের পরিচিতও করাতে হয়। এই কাজ একদিকে যেমন খুবই জটিল আবার অন্যদিকে এর জন্য নিখুঁতও হওয়া প্রয়োজন যাতে যথা সময়ে যথা স্থানে বাহিনীকে পাওয়া যায়।"
আরও পড়ুন, আজ নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই কোচবিহারে বিজেপি-র ‘আইটি যোদ্ধা’ দীপকের
নির্বাচন কমিশনের সদর দফতর দিল্লিতে রয়েছে বটে, কিন্ত এই পরিমাণ কর্মকাণ্ডের জন্য তা যথেষ্ট নয়। সংবিধানে বলা আছে, দেশের রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যের রাজ্যপালকে নির্বাচন সংগঠিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় কর্মী দিয়ে সমস্ত রকম সহায়তা করতে হবে। প্রয়োজনীয় কর্মীর প্রসঙ্গ আসে ১৯৯৩ সালের বিতর্কের পর। এর পরে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয় নির্বাচন সংগঠিত করার জনয নির্বাচন কমিশন এবং সরকার একযোগে কর্মী ও নিরাপত্তা কর্মী নিযুক্ত করবে।
দিনক্ষণ স্থির করা
দিন ঠিক করা প্রথম চ্যালেঞ্জ। বেশ কিছু নির্বাচনী বৈঠকে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিআরপিএফের এক আধিকারিক বলছিলেন, "প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব সাংস্কৃতিক এবং ধার্মিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। ফলে উত্তরপূর্বের রাজ্য গুলিতে যদি নির্বাচনের দিন ঠিক করা হয়, তাহলে দেখতে হবে যাতে ওই সাত রাজ্যে সেদিন কোনও উৎসব না থাকে। এবং সমস্ত রাজ্যের নিজেদের উৎসব রয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের কাছে শুরু করার জন্য দিনের সংখ্যা খুবই কম থাকে। তাঁর কথায় সম্মতি দিলেন নির্বাচন কমিশনের এক আধিকারিক, আমাদের খেয়াল রাখতে হয় হোলির মতো উৎসবের কথাও, যা সারা দেশে পালিত হয়, আবার মাথায় রাখতে হয় স্থানীয় উৎসবের কথাও। যেেমন আসামে রঙালি বিহুর দিন আমরা ভোট করাতে পারি না।"
ফলে প্রথম ধাপ হল সরকারি ছুটির তালিকা তৈরি করে ফেলা। আবার দৈনন্দিন ধর্মীয় অনুশীলনের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির বাসিন্দাদের বড় অংশ প্রতি রবিবার গির্জায় যান, ফলে আমরা সে দিন ভোট করাতে পারি না। আবার কেরালায় মুসলিম জনসংখ্যার কারণে, আমরা শুক্রবারগুলি এড়িয়ে যাই।
আবার মাথায় রাখতে হয় পরীক্ষার কথা এবং আবহাওয়ার কথাও। ওই নির্বাচনী আধিকারিক বলছিলেন, "উদাহরণ হিসেবে, উত্তরপূর্বের মতন যেসব রাজ্যে দ্রুত বর্ষা আসে সেখানে এপ্রিলের মধ্যে ভোট সেরে ফেলতে হয়।"
এক প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের মতে, "কমিশন সাধারণত বিভিন্ন তারিখ দিয়ে ডামি ক্যালেন্ডার তৈরি করে। গোপনীয়তা সুনিশ্চিত করার জন্য এটা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন এজেন্সি এবং রাজ্য সরকারের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় ঘটাতে হয় আবার যাতে আসল দিনতারিখ গোপন থাকে, তাও দেখতে হয়।"
পথে বাহিনী
নির্বাচন কমিশন তারিখের তালিকা প্রকাশ করার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বাহিনী সরানোর ব্যাপারে সর্বোত্তম দিন স্থির করে। এর মধ্যে থেকেই বেছে নেওয়া হয় আসল দিন তারিখ।
"ত্রিপুরায় যে বাহিনী নিযুক্ত করা হয়েছে, তাকে পরের পর্যায়ে ভোটের জন্য কন্যাকুমারীতে নিয়ে যাওয়া যায় না। দূরত্ব একটা বড় ব্যাপার। ফলে নিকটবর্তী বাহিনীর উপস্থিতি এবং তাদের যাতে সবচেয়ে কম যাতায়াত করতে হয়, তা মাথায় রেখে দিন স্থির করতে হয়। যাতে যাতায়াত সহজ হয়, এবং বাহিনী প্রয়োজনীয় বিশ্রাম পায়, সে করাণে দুটি পর্যায়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সময় রাখতে হয়।"
ছত্তিসগড়, জম্মু-কাশ্মীর এবং উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি, যেখানে বাম উগ্রপন্থী অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থীরা রয়েছে, সেখানে শুরুতেই ভোটগ্রহণ পর্ব সেরে ফেলা হয়, কারণ সে সময়ে জওয়ানরা ক্লান্ত থাকে না। এর পরেই আসে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং লাক্ষাদ্বীপ ও উত্তরাখণ্ডের পাহাড়। সিআরপিএফের এক সিনিয়র আধিকারিক বলছিলেন, "আন্দামান বা লাক্ষাদ্বীপে যাতায়াত করতেই অনেক সময়ে লেগে যায়। কলকাতা এবং তামিলনাড়ি থেকে তিন চার দিন লাগে জাহাজে করে আন্দামান বা লাক্ষাদ্বীপ পৌঁছতে। সেখানে আবার দ্বীপগুলিতে পৌঁছতে হয় ফেরি এবং নৌকো চড়ে। পাহাড়ে উপরে উঠতে সময় লাগে।"
ছত্তিশগড়ে ভোটের দিন স্থির করার সময় মাথায় রাখতে হয় অমাবস্যা-পূর্ণিমার কথা। "ছত্তিসগড়ের নকশাল অধ্যুষিত কিছু জায়গায় বাহিনীকে রাতের অন্ধকারে পথ চলতে হয়। সে জন্য ৫টা থেকে ৭টার মধ্যে চাঁদ ওঠা জরুরি যাতে ভোরবেলা পুরো চাঁদের আলোটা পাওয়া যায়।"
উত্তরপ্রদেশে যে বাহিনীকে নিযুক্ত করা হয় তাদের ক্রমশ পূর্বদিকে পাঠানো হতে থাকে। বিহারে যাদের নিয়োগ করা হয় তাদের পূর্বদিক থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর দিকে। এর ফলে উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিম বিহারের জেলাগুলি যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে শেষ দুদফার ভোটের সময়ে বাহিনীর সংখ্যাও বেশি থাকবে।
আবার উত্তরপূর্বে যে বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে, তারা পরে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশায় চলে আসবে। অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় যারা রয়েছে, তারা কর্নাটক, তামিল নাড়ু ও কেরালায় চলে আসবে।
ঘটনাস্থলে বাহিনী
থাকার জায়গা এবং খাবারের বন্দোবস্ত করা একটা বড় ব্যাপার। "রাজ্য সরকার থাকার বন্দোবস্ত করে। কিন্তু ছত্তিসড়ের সুকমার স্কুলগুলিতে আমাদের স্যান্ডব্যাগ দিয়ে কোনও রকমে ক্যাম্প তৈরি করতে হয়", বলছিলেন এক সিআরপিএফ আধিকারিক।
শুধু বুথ বা থাকার বন্দোবস্তের সুরক্ষাই নয়, ছত্তিসগড় এবং ওড়িশায় রাস্তাতেও সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হয়। এ জন্য ট্রাক বাসের চালক এবং নিত্য যাতায়াতকারীদেরও চোখ কান খোলা রাখতে বলা হয়।
রান্না করতে গিয়ে যাতে সময় নষ্ট না হয়, যাতে ট্রেনে করে যে বাহিনী যাচ্ছে, তাদের খাবার সরবরাহের জন্য সিআরপিএফ আইআরসিটিসি-র সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। এর আগে স্টেশনে নেমে বাহিনীর লোকজন প্ল্যাটফর্মে খাবার বানাত, যার ফলে সময়ে পৌঁছনো নিয়ে চাপ তৈরি হত।
"প্রতিটি বুথের ক্ষেত্রে আবার নিজস্বতা রয়েছে, যেখানে একটি বুথের নিরাপত্তার জন্য় ৫ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত নিরাপত্তারক্ষী প্রয়োজন হতে পারে। বুথে হিংস্রতা এবং সমস্যার একটি ম্যাপ তৈরি করা হয়ে গেছে। এর আগে সমস্যা সামলানো গেছে কীভাবে, তাও দেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করেই বাহিনী নিয়োগ করা হয়েছে। অগ্রিম ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।"
Read the Full Story in English