লকডাউন তুলে নেবার সমস্ত রাস্তার মধ্যেই সংক্রমণ বাড়বার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজ করার অনুমতি দিয়েও সে ঝুঁকি কীভাবে ন্যূনতম করা যায়! সরকার ব্যাপারটা দেখছে ভৌগোলিক ভাবে। এটি অত ঝুঁকিপ্রবণ পদক্ষেপ হতে পারে এবং অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
একটা বেশি কার্যকর, কম ঝুঁকিপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে যে ধরনের কাজ চালু হবে তার কর্মীদের মধ্যে অ্যান্টিবডি ও পিসিআর পরীক্ষার যৌথ কৌশলের মাধ্যমে সংক্রমণশূন্য কর্মিগোষ্ঠী তৈরি করা। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। সরকার তিনটি জোন তৈরি করেছে, সবুজ, কমলা ও লাল। সবুজ জোন হল, শেষবার কোনও পরীক্ষার নেগেটিভ ফল আসার পর গত ২৮ দিনে কোনও নতুন সংক্রমণ ধরা পড়েনি। কমলা জোনে সামান্য সংক্রমণ ধরা পড়েছে, রেড জোনে সংক্রমণের হার বেশি।
মহারাষ্ট্রে একদিনে ৭৭৮ সংক্রমণ, দেশেও দৈনিক সংক্রমণে রেকর্ড
সরকার বলছে গ্রিন জোন প্রথমে খুলে দেওয়া হবেে। কিন্তু এই এলাকায় উপসর্গবিহীন সংক্রমিত থাকতে পারেন। দিল্লি সরকার সম্প্রতি দেখেছে তাদের ২৫ শতাংশ সংক্রমিতের মধ্যে উপসর্গ নেই। চিনে উপসর্গবিহীন সংক্রমিতের সংখ্যা ৪৪ শতাংশ।
সংখ্যার দিক থেকে এগুলি যথেষ্ট বেশি। গ্রিন জোন যদি খুলে দেওয়া হয় এবং সেখানে যদি উপসর্গবিহীন সংক্রমিত থাকেন, তাহলে সংক্রমণ সংখ্যা বাড়বে। কারখানায় যদি কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করেন, তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সত্ত্বেও একজন উপসর্গবিহীন অনেকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম হবেন, যার জেরে গোটা ইউনিটকে কোয়ারান্টিনে যেতে হবে। ফলে কারখানা খোলার উদ্দেশ্যই মাঠে মারা যাবে। তার উপর অনেক কারখানাই রেড জোনে অবস্থিত, এবং জোগান শৃঙ্খলের ক্ষেত্রে তা একেবারেই কোনও জোন মেনে চলে না।
যেমন হিমাচলপ্রদেশের বাড্ডি শহরে ভারতের বৃহত্তম ফার্মা হাব রয়েছে, যেখানে বড় বড় সংস্থা অসংখ্য প্রয়োজনী ওষুধ তৈরি করে, যা দেশিয় বাজারে কাজে লাগে ও রফতানি হয়। এ এলাকা রেড জোনের মধ্যে পড়ছে এবং এখানে যদি উৎপাদন শুরু করে দেওয়া হয় তাহলে ভিন রাজ্যে থেকে শ্রমিকরা আসবেন। তাঁরা যদি সংক্রমণের বাহক হন, তাহলে কী হবে?
কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক- মানুষের উপর পরীক্ষা শুরু
এর চেয়ে কম ঝুঁকির হল গ্রিন ওয়ার্কারদের গোষ্ঠী তৈরি করা, যাঁরা সংক্রমণ মুক্ত। কোনও শিল্প যদি খুলতে হয় (এবং তার অনুমতি দেওয়া উচিত, সে প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয়, যে সামগ্রীই হোক না কেন), তাহলে তেমন কর্মীদের চিহ্নিত করতে হবে।
যাঁরা ভাইরাস থেকে সেরে উঠেছেন তাঁদের কিছুটা প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তাঁদের কোনও সার্টিফিকেট দেওয়া যেতে পারে বা হাতে ছাপ মেরে দেওয়া যেতে পারে। তারপর ওই শিল্পের বাকি কর্মীদের অ্যান্টিবডি টেস্ট করা হোক। এই পরীক্ষার একঘন্টার মধ্যে জানা যাবে তাঁরা উপসর্গবিহীন হলেও সংক্রমণমুক্ত কিনা।কিছু অ্যান্টিবডি কয়েকদিন পর ধরা পড়তে পারে, কিছু আরেকটু বেশি পরে।
যাঁদের এই টেস্টের পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসবে, তাঁরা সংক্রমিত হতে পারেন, বাকিরা সেরে উঠবেন। যাঁদের রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে তাঁরা গ্রিন কর্মীদের সঙ্গে কাজে যোগ দিতে পারবেন। যাঁদের পজিটিভ আসবে, তাঁরা ৭-৮ দিন কোয়ারান্টিনে থাকবেন এবং ফের পিসিআর টেস্ট করিয়ে মুক্ত হতে পারবেন।
এর ফলে কর্মীদের একটা গোষ্ঠী তৈরি হবে যাঁরা অন্যদের ও নিজেদের বিপদে ফেলার আশঙ্কা বিহীনভাবে কাজ করতে পারবেন। তাঁদের অন-সাইটে থাকার ব্যবস্থা করার দরকারও নেই, যেহেতু তাঁদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে, তাঁরা রেড সহ যে কোনও জোন থেকে আসতে পারেন।
অ্যান্টিবডি টেস্টের ফলস নেগেটিভ ও ফলস পজিটিভের কী হবে?
গ্রিন কর্মীদের গোষ্ঠীর মধ্যে ফলস নেগেটিভের সম্ভাবনা নেই। ফলস পজিটিভ, অর্থাৎ যাঁরা সংক্রমিত না হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের অ্যান্টিবডি দেখা যাচ্ছে, তাঁদের পিসিআর টেস্টেও যদি দেখা যায় যে তাঁরা সংক্রমণ শূন্য এবং নিজেদের তাঁরা ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে রাখেন, তাঁদের ন্যূনতম ঝুঁকিপ্রবণ কর্মিগোষ্ঠীতে যুক্ত করা যায়। তাঁদের মধ্যে কিছুটা ঝুঁকি থাকবে কারণ তাঁদের প্রতিরোধক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু তাঁদের সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা রয়েছে।
কোভিড ১৯ মোকাবিলা- কেরালার রাস্তা
দ্বিতীয় বিষয় হল, অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জন্য ব্যবসা ও পরিষেবা চিহ্নিত করা।
স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মীরা এই তালিকার শীর্ষে থাকবেন। এরপর হল যেসব সংস্থা পিপিই, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও ওষুধ বানায়, তারা। কিন্তু তাদেরও গ্রিন কর্মীদের গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া যে কোনও কারখানা বা ব্যবসায়ী সংস্থা খোলবার অনুমতির দেবার আগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গ্রিন কর্মী পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে, তা সে যে জোনেই অবস্থিত হোক না কেন। এ ব্যাপারে লাল ফিতের ফাঁস খুবই ন্যূনতম হতে হবে। গ্রাহক চাহিদা কম থাকায় খুব কম সংখ্যকরাই এই ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারেন।
গ্রিন জোনের বদলে গ্রিন কর্মীদের উপর নজর দিলে কাজের জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করার প্রয়োজনও কম হবে, যে ব্যবস্থা অধিকাংশ ব্যবসাতেই নেই। কিন্তু যাঁরা চান, তাঁরা ক্লাস্টার সংক্রমণের সম্ভাবনা কমাতে এ ব্যবস্থা করতে পারেন, যদি তাঁদের কর্মীদের আগে পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় বিষয় হল পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা, যাঁরা কাজে যোগ দিতে পারেন, কিন্তু বর্তমানে রাজ্যে রাজ্যে লকডাউন চলায় যাঁদের থাকার বন্দোবস্ত নেই।
তাঁদের জন্য স্টেডিয়াম, কনভেনশন কেন্দ্রর মত বড় জায়গা খুলে দেওয়া যেতে পারে। এর ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে, স্নান ও শৌচাগারের বন্দোবস্ত থাকবে, কমিউনিটি কিচেন বা নিজেদের রান্নার ব্যবস্থা থাকবে, ভাইরাস টেস্টিং করা যাবে, এমনকি পরিবহণের জন্য বাস রাখার জায়গাও পাওয়া যাবে। কোনও কোনও রাজ্যে এ কারণে স্কুল ও কলেজ ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু সেগুলি খুলতেও হবে, এবং এসব ক্ষেত্রে স্টেডিয়ামের মত বড় জায়গা মিলবে না, যেখানে কয়েক হাজার মানুষ থাকতে পারেন।
আসলে আমাদের প্রয়োজন কার্যকরী কিন্তু কম ঝুঁকিপ্রবণ কৌশল যাতে সকলে কাজে ফিরতে পারেন এবং লকডাউন তুলে নেওয়া যেতে পারে। এলাকাভিত্তিক পদক্ষেপ অকার্যকর ও অতি ঝুঁকিপ্রবণ হবার সম্ভাবনা বেশি।
(বীণা আগরওয়াল ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস অ্যান্ড এনভায়র্নমেন্টের অধ্যাপক)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন