Advertisment

Good Maharaja: ভারতের এক মহারাজা, যাঁকে আজও সেলাম ঠোকে পোল্যান্ড, কিন্তু কেন?

Polish WWII refugees: আধুনিক ভারতের ইতিহাসে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর মত এই ধরনের রাজারাও উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছেন

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Good Maharaja, Polish WWII refugees, ভালো মহারাজা, পোল্যান্ডের রিফিউজি,

Good Maharaja-Polish WWII refugees: শিশুরা মহারাজাকে জামসাহেব বাপু বলে ডাকতেন। (ছবি- এক্সপ্রেস)

Gujarat ruler hosted Polish WWII refugees: রাজা মহারাজা বললেই বর্তমান সমাজের চোখে ভেসে ওঠে মদ্যপ লাল চোখের মস্ত গোঁফওয়ালা কোনও মানুষের মুখ। যে প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে। প্রজাদের ঘরে আগুন দেয়। প্রজাদের মেয়ে, বউদের নিয়ে জোর করে ফুর্তি করে। দুশো বছরের শাসনকালে দেশীয় রাজাদের এমন ছবিই ভারতীয়দের চোখে এঁকে গিয়েছে বৃটিশরা। কিন্তু, বৃটিশদের দেখানো এই ছবিটা সর্বাংশে সত্যি ছিল না। 

Advertisment

মহারাজা দিগ্বিজয় সিং জাদেজা
এমনই এক মহারাজা ছিলেন দিগ্বিজয় সিং জাদেজা। তিনি মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর ভাইপো। এই রঞ্জিত সিং-এর নামেই ক্রিকেটের রঞ্জি ট্রফি। রাজকোটে পড়াশোনা করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য দিগ্বিজয় সিং লন্ডনের মালভার্ন কলেজ (Malvern College)-এ ভর্তি হন। স্নাতক হবার পর ১৯১৯ সালে তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মিশর দখলে অসামান্য বীরত্বের জন্য পুরস্কারও পান। প্রায় দু'দশক ব্রিটিশ সেনায় কাজ করার পর ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন পেয়েছিলেন। আর, ১৯৩১ সালে বাহিনী থেকে অবসর নেন। তাঁর কাকা রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর পর দিগ্বিজয় সিং ১৯৩৩ সালে জামনগরের সিংহাসনে বসেন। সেবামূলক কাজের জন্য ১৯৩৫ সালে তাঁকে বৃটিশ সরকার 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। 

মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি
তাঁর কৃতিত্ব অর্থাৎ পোল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা অবশ্য অন্য জায়গায়। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর,  হিটলারের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ডের ওপর। অপ্রস্তুত পোল বাহিনী সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। রাজধানী ওয়ারশ-সহ পতন ঘটেছিল গোটা পোল্যান্ডের। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিল। তার আগে ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে দুই বৃহৎ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং নাৎসি জার্মানির মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তাতে লেখা ছিল, কোনও পরিস্থিতিতেই তারা একে অপরকে আক্রমণ করবে না। এই চুক্তি মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি বলে পরিচিত। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পিছনে অলিখিত শর্তটা ছিল মারাত্মক। দুই ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিন ও হিটলার ঠিক করেছিলেন যে তাঁরা পোল্যান্ড দখল করে নেবেন। মধ্য ইউরোপের ছবির মতো ছোট্ট দেশ পোল্যান্ডের রাজধানী হল ওয়ারশ।

Gujarat ruler, Polish WWII refugees, গুজরাটের শাসক, পোল্যান্ডের রিফিউজি,

সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যাচার
এরপরই হিটলারের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে পোল্যান্ডের ওপর। পোল্যান্ডের পশ্চিম অংশ চলে যায় জার্মানির দখলে। পনেরো দিন পর অর্থাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বর, পোল্যান্ডের রক্ষাকর্তা সেজে পূর্ব অংশে ঢুকে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের রেড আর্মি। সোভিয়েত সেনা স্থানীয় পোলিশদের আশ্বস্ত করে বলেছিল যে তারা নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে এসেছে। কিন্তু, অল্পদিনের মধ্যেই পোলিশদের মোহভঙ্গ হয়। রুশ সিক্রেট পুলিশ প্রায় পাঁচ লক্ষ পোলিশ নাগরিককে বন্দি করে অকথ্য অত্যাচার চালায় বলে অভিযোগ। এর জেরে ১৯৩৯ সালে লোকদেখানো নির্বাচন হয় পূর্ব পোল্যান্ডে। সেই নির্বাচনের ফল দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন 'গণতান্ত্রিক কায়দায়' পোল্যান্ডের অর্ধেক দখল করে নেয়। পদস্থ আমলা এবং সেনা আধিকারিকদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। নিখোঁজ হয়ে যান অসংখ্য সাধারণ পোলিশ নাগরিক। সেসময় রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১.৫০ কোটি। 

অসউইজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
১৯৪০ সালে পশ্চিম পোল্যান্ডে নাৎসিরা চালু করেছিল কুখ্যাত অসউইজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সেসময় অসউইজই ছিল পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। যা ছিল, মূলত রাজনৈতিক বন্দি শিবির। সেখানে জার্মানির শত্রু এবং ইহুদিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হত। অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বন্দিদের অনেকেই মৃত্যুকে বেশি পছন্দ করতেন। বন্দিদের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হত। আর, শক্তসমর্থ বন্দিদের গিনিপিগ বানিয়ে তাঁদের ওপর নানারকম পরীক্ষা চালাত নাৎসি জার্মানির বিজ্ঞানীরা। এতে অসংখ্য ইহুদি ও নাৎসি-বিরোধী মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে হলোকাস্টের সময়, অসউইচ বা আউৎসভিচ কারাগারে বন্দিদের ওপর এই নারকীয় অত্যাচারের কাহিনি শুনে গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন- মহিলাদের বিয়ের বয়স বাড়ল, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং জনস্বাস্থ্যে জোর, বেড়ে কত হল জেনে নিন

অত্যাচারে পিছিয়ে ছিল না সোভিয়েতও
পোলিশদের ওপর অত্যাচারে পিছিয়ে ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নও। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সাল, এই দু'বছরে স্তালিন পোলিশদের নিজেদের দেশ থেকে জোর করে সাইবেরিয়ার দুর্গম এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। জোর করে সেখানকার লেবার ক্যাম্পগুলোতে পোলিশদের কাজ করতে বাধ্য করা হত। স্থানীয় ভাষায় এই লেবার ক্যাম্পগুলোকে বলা হত 'গুলাগ'! নামে শ্রমশিবির হলেও আসলে এই সব লেবার ক্যাম্প নরকের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। ভয়ঙ্কর ঠান্ডার মধ্যে বন্দিদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হতো। পর্যাপ্ত খাবার বা শীতবস্ত্র দেওয়া হত না। একটি রিপোর্ট বলছে, সাইবেরিয়ায় নিয়ে যাওয়া ৪০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৭ লক্ষ অনাহার, শীতে মারা গিয়েছিলেন। তার এক-তৃতীয়াংশ আবার ছিল নাবালক ও নাবালিকা।

পরিস্থিতি বদলে যায় হিটলারের আক্রমণে 
কিন্তু, চুক্তি ভেঙে হিটলার রাশিয়ার ওপর আক্রমণ করতেই পরিস্থিতিটা বদলে যায়। সোভিয়েত প্রশাসন প্রায় বাধ্য হয়েই মুক্তি দেয় বন্দি পোলিশ নাগরিকদের। কুখ্যাত সব বন্দিশিবিরের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রায় একহাজার ভীত পোলিশ নাগরিক অজ্ঞাত নৌবন্দর থেকে অজানা পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। যার মধ্যে ছিল ৫০০ মহিলা আর ২০০ শিশু। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এই সমুদ্রযাত্রায় তাঁরা ইউরোপে কোনও বন্দরে নামার অনুমতি পাননি। শেষমেষ এডেন হয়ে পৌঁছন তেহরান বন্দরে। সেখানেও নামতে না পেরে পৌঁছন বোম্বাই বন্দরে। কিন্ত, বোম্বাইয়ের বৃটিশ গভর্নর দু'দিন জাহাজ নোঙর করার পরও ওই পোলিশদের বন্দরে নামার অনুমতি দেননি।

জামনগরের মহারাজার কৃতিত্ব

এই সময় গুজরাটের দেশীয় রাজ্য নওনগিরি, বর্তমান যার নাম জামনগর, সেখানকার মহারাজা দিগ্বিজয় সিং সেসময় ছিলেন বোম্বাইতে। তিনি সব শুনে পোলিশ নাগরিকদের জাহাজ নিজের রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। রাজধানী থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতীরে বালাচাডি গ্রামে ওই পোলিশ নাগরিকদের থাকার জন্য শিবির নির্মাণ করে দেন। তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা ওই বিদেশিদের নওনগিরিতে থাকার ব্যাপারে যথেষ্ট আপত্তি করেছিল। কিন্ত, মহারাজা সেসবের পরোয়া করেননি। শুধু থাকার ব্যবস্থা করাই নয়। মহারাজা, কমবয়সি পোলিশদের জন্য বোম্বাই থেকে ইংরেজির শিক্ষকও আনিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের পড়াশোনা শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় রান্না তাঁরা খেতে পারতেন না। সেই জন্য গোয়া থেকে আনিয়েছিলেন পর্তুগিজ বাবুর্চিকে!

পোল্যান্ড কীভাবে মহারাজাকে মনে রেখেছে?
নিজেদের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা এই শরণার্থীরা যাতে অসুবিধায় না পড়ে, সেদিকে মহারাজা দিগ্বিজয় সিংয়ের তিক্ষ্ণ নজর ছিল। তিনি তাঁদের বলতেন, 'তোমরা নিজেদের অনাথ ভেব না। তোমরা এখন নওনগড়ের বাসিন্দা। আর, আমি হলাম বাপু। নওনগড়ের প্রত্যেক মানুষের বাবা, তাই তোমাদেরও বাবা।' ছ'বছর পর ১৯৪৬ সালে যুদ্ধ থামলে ওই পোল্যান্ড বাসীরা ফিরে যান। কিন্ত, স্বল্পকালে ভারতে বসবাসের স্মৃতি তাঁরা আজও মনে রেখেছেন। পরবর্তীকালে ওই শিশুদের একজন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জাম সাহেবের স্মৃতিতে পোল্যান্ডের বহু রাস্তা নামাঙ্কিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পোল্যান্ডের সরকারি অনেক প্রকল্প এখনও তাঁর নামে চলে। সেদিনের সেই উদ্বাস্তুদের বংশধররা নিয়ম করে জামনগরে মহারাজকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। সেই মহারাজা দিগ্বিজয় সিংয়েরই বংশধর হলেন ভারতীয় ক্রিকেটার অজয় জাদেজা।

India modi gujrat poland
Advertisment