মতাদর্শগত প্রচারে জোর দিতে গিয়েই বিজেপির নৌকো ডুবছে

নির্বাচনী ভাষণে যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী ইরফান আনসারিকে ভোট দিলে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজে সুবিধা হবে না। ইরফান আনসারি জেতেন ৪০ হাজার ভোটে।

নির্বাচনী ভাষণে যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী ইরফান আনসারিকে ভোট দিলে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজে সুবিধা হবে না। ইরফান আনসারি জেতেন ৪০ হাজার ভোটে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
bjp delhi election

মঙ্গলবার নয়া দিল্লির বিজেপি দফতর (ফোটো- অভিনব সিনহা)

বিজেপি ৯ মাস আগে লোকসভা ভোটে রেকর্ড সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তার পর মঙ্গলবার দিল্লিতে যা ঘটল তা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই নিচে, অন্তত নির্বাচনী হিসেবে।

Advertisment

বিজেপি শাসিত জোটের ফল মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লিতে যা দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপির কঠোর মতাদর্শগত প্রচার তাদের রাজ্যগুলিতে ক্ষমতায় ফেরা থেকে বঞ্চিত করছে। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা বিধানসভা ভোটে প্রচার বিষয় ছিল ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি ও জম্মু কাশ্মীর বিভাজন, ঝাড়খণ্ড ভোটে ছিল রাম মন্দির এবং দিল্লি ভোটে ছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।

দিল্লি ভোটের ফলের দিন মৌন শাহিনবাগ

মাত্র ৯ মাস আগের লোকসভা ভোটে দিল্লি বিধানসভার  ৬৫ থেকে ৭০টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বিজেপি। এনসিআরের অবৈধ কলোনিগুলিকে ছাড়পত্র দেবার ব্যাপারে কেন্দ্রের যে সিদ্ধান্ত, যার ফলে ৪০-৫০ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন, তাকে ভর করে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল তারা।

Advertisment

কিন্তু বিজেপি যখন তিন সপ্তাহ আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে প্রচার শুরু করে, তখন অবৈধ কলোনি, আয়ুষ্মান ভারতের মত কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প থেকে নজর সরিয়ে তাদের মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে শাহিনবাগের ক্যা বিরোধী বিক্ষোভ, যেখানে প্রায় দু মাস ধরে মহিলারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

দলের অভ্যন্তরে আত্মবিশ্বাস ছিল যে এই চিত্রনাট্য কাজ করছে- তাদের নিজস্ব সমীক্ষা বলেছিল, এই উগ্র প্রচার মধ্যবর্তীদের বিজেপির দিকে নিয়ে আসবে। অমিত শাহ ভোটের কয়েকদিন আগে বলেছিলেন দল ৪৫টির বেশি আসন পাবে।

বিজেপি গত এক মাসের বেশি সময়ে ৬৫৭৭টি প্রকাশ্য সভা করেছে, এর মধ্যে অমিত শাহের ৫২টি রোড শো ও জনসভা রয়েছে। প্রায় ৩০টি ভাষণে অমিত শাহ বলেছেন, ইভিএমের পদ্ম বোতামে এত জোরে চাপ দিতে যে তার থেকে কারেন্ট গিয়ে শাহিনবাগের বিক্ষোভকারীদের যেন সেখান থেকে হঠিয়ে দিতে পারে। একই রকম বার্তা এসেছে অন্যদের কাছ থেকেও। বিজেপি সাংসাদ পরবেশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সন্ত্রাসবাদী বলেছেন, অনুরাগ ঠাকুর শ্লোগান দিয়েছেন দেশকে গদ্দারোঁ কো, জনতা আওয়াজ তুলেছে গোলি মারো সালোঁকো। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিক্ষোভকারীদের বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশের শান্তি বিঘ্ন করার চক্রান্তের হদিশ পেয়েছেন।

স্পষ্টতই এসব কথা বহু ভোটারদের মধ্যে কোনও সাড়া ফেলেনি।

দলের নেতারা মেনে নিচ্ছেন দিল্লির ফল তাঁদের কাছে বড় ধাক্কা, কারণ তাঁরা অন্তত ২০-২৫টি আসন প্রত্যাশা করেছিলেন। দলের এক প্রবীণ সাংসদ বললেন, "আমরা যে বড়সড় সংসদীয় উদ্যোগগুলি নিয়েছি, তার পক্ষে সমর্থন রয়েছে এটা দেখানোর জন্যই আমাদের জেতা প্রয়োজন ছিল। শুধু নাগরিকত্ব ইস্যু নয়, আর্থিক ইস্যুতেও আমরা যে সমালোচনার মুখে পড়ছি, তার জবাব দেবার জন্যই ভাল ফল করা দরকার ছিল।"

দিল্লি ভোটে আপের ক্লিন সুইপ, বিজেপির কাছে এর অর্থ কী?

বিজেপি সূত্র বলছে, দিল্লির ফল লোকসভা ভোটের পর আরও একবার বার্তা দিল যে রাজ্যের ভোট লোকসভা ভোট নয়। ওড়িশায়  লোকসভার সঙ্গেই হয়েছিল রাজ্য বিধানসভার ভোট। সেখানে লোকসভায় ২১টি আসনের মধ্যে ৮টি পায় বিজেপি, ভোট শেয়ার ছিল ৩৮.৪ শতাংশ। অথচ বিধানসভায় তারা ১৪৭টির মধ্যে মাত্র ২৩টি আসন পায়, ভোট শেয়ার ৩২.৫ শতাংশ। একইভাবে, বিজেপি ঝাড়খণ্ডে ১৪টির মধ্যে ১১টি আসনে জিতেছে লোকসভা ভোটে। অথচ ৬ মাসের মধ্যে বিধানসভা ভোটে তারা কল্কে পায়নি।

হরিয়ানার আহিরওয়াল এলাকায় রেওয়ারি বিধানসভা এলাকার নাম সেখানকার অধিকাংশ মানুষ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বলে। এখানে প্রচারে বিজেপি বিজেপি জোর দিয়েছিল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার নিয়ে। বিজেপি জেতেনি। ৩৭০ ধারা নিয়ে প্রচার সত্ত্বেও তাদের হাতছাড়া হয়েছে নাগপুর। একইভাবে ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ায় এক নির্বাচনী ভাষণে যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, সেখানকার কংগ্রেস প্রার্থী ইরফান আনসারিকে ভোট দিলে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজে সুবিধা হবে না। ইরফান আনসারি জেতেন ৪০ হাজার ভোটে।

এসব খুঁটিনাটি তথ্য যদি বাদও দেওয়া হয়, বিজেপি-শিবসেনা জোট এবার ২৯টি আসনে জিতেছে। ২০১৪ সালে আলাদা ভাবে লড়ে যা আসন পেয়েছিল দু দল, জোটের আসন তার চেয়ে কম হয়েছে। বিজেপি হরিয়ানায় মোট আসনের অর্ধেকও জিততে পারেনি। তারপর ভোট পরবর্তী জোট গড়েছে সরকার গঠনের জন্য। ২০১৪ সালে ব্যাপক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে গঠিত সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের প্রায় সকলেই এবং রাজ্য প্রধান ভোটে হেরেছেন। ঝাড়খণ্ডেও বিজেপি শুধু ক্ষমতা হারায়নি, তাদের মুখ্যমন্ত্রীও নিজের আসনে জিততে পারেননি।

অমিত শাহ এখনও এ ফল নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি।

দিল্লিতে দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। আসন্ন ভোটে তারা প্রভাব ফেলতে পারবে না এমন ভেবে নেবার কারণ নেই। বিহারে যদি আসন ভাগাভাগির ব্যাপারে জোটসঙ্গীকে একটু বেশি জায়গা দেয় তারা আর পশ্চিমবঙ্গে তাদের কৌশল ঢেলে সাজায়, তেমনটা হতেও পারে। এ বছরের শেষে বিহার ভোট। সামনের বছর ভোট পশ্চিমবঙ্গে।