Advertisment

গালওয়ান সংঘর্ষ: অস্ত্র থাকতেও কেন গুলি চালায় নি ভারতীয় ফৌজ?

একাধিক সামরিক আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে যে ভারতীয় সেনার যে বাহিনীর সঙ্গে চিনাদের সংঘর্ষ বাঁধে, সেই দলের অধিকাংশের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
india china galwan faceoff

বীরভূমের বেলগড়িয়া গ্রামে রাজেশ ওরাংয়ের শেষকৃত্য

লাদাখে ভারত-চিন সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে টুইটারে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ একটি তথ্য প্রকাশ্যে এনে দেয় - ভারতীয় সৈনিকদের কাছে অস্ত্র ছিল, কিন্তু সেগুলি ব্যবহৃত হয় নি। মন্ত্রী বলেন যে "সীমান্তে টহলদারি করতে গিয়ে সবসময়ই অস্ত্র সঙ্গে রাখেন সৈনিকরা, বিশেষ করে পোস্ট ছেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। ১৫ জুন গালওয়ানেও তাই করা হয়। সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার দীর্ঘদিনের রেওয়াজ (১৯৯৬ ও ২০০৫ এর চুক্তি অনুযায়ী)"।

Advertisment

যে দুটি চুক্তির কথা জয়শঙ্কর বলছেন, সেগুলি ভারত ও চিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালে। প্রথমতির বিষয়বস্তু ছিল ভারত-চিন সীমান্ত এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সামরিক ক্ষেত্রে আস্থাবর্ধক পদক্ষেপ। এই চুক্তির ৬ (১) নং অনুচ্ছেদের সার বক্তব্য, "ভারত-চিন সীমান্ত এলাকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিপজ্জনক সামরিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে... কোনও পক্ষই গুলি চালাবে না, জৈব-অবনতি (bio-degradation) ঘটে এমন কিছু করবে না, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করবে না, বিস্ফোরণ ঘটাবে না, বা আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দু'কিলোমিটারের মধ্যে শিকার করবে না। ছোট আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ফায়ারিং রেঞ্জে বা চাঁদমারিতে নিয়মমাফিক অভ্যাসের ক্ষেত্রে এই চুক্তি বলবৎ হবে না।"

আরও পড়ুন: চিন নিয়ে সংসদীয় কমিটির সতর্কীকরণ 

তবে বর্তমান ক্ষেত্রে ওই চুক্তির ৬ (৪) নং অনুচ্ছেদ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। মোটের ওপর যা বলা হয়েছে তা হলো, "উভয় পক্ষের সীমান্তরক্ষীরা যদি একে অপরের সঙ্গে যে কোনও কারণে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, তবে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এবং পরিস্থিতি যাতে আর না এগোয়, সেই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। উভয় পক্ষই অবিলম্বে কূটনৈতিক/অন্যান্য মাধ্যমে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করবে।"

তবে ১৯৯৬-এর চুক্তির সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ১০ (১) নং অনুচ্ছেদে একটি শর্ত, যা বলছে যে "বর্তমান চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নির্ভর করছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার বিস্তার সম্পর্কে উভয় পক্ষের বোঝাপড়ার ওপর... এই প্রেক্ষিতে উভয় পক্ষই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নির্দিষ্ট করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে স্বীকৃত হচ্ছে"।

অন্যদিকে ২০০৫ সালের চুক্তির প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে "উভয় পক্ষ সীমান্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান করবে। কোনোভাবেই একে অপরের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করবে না বা করার হুমকি দেবে না"। এতেই শেষ নয়, ২০১৩ সালে সীমান্ত প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা সংক্রান্ত স্বাক্ষরিত একটি চুক্তিতেও উল্লেখ করা হয় যে কোনও পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে সামরিক ক্ষমতার প্রয়োগ করবে না।

একটি অনুচ্ছেদেও অবশ্য সোমবারের সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির উল্লেখ নেই, যখন গালওয়ান উপত্যকায় চিনা বাহিনীর পাশবিক আক্রমণের শিকার হন ভারতীয় সৈনিকরা। জয়শঙ্কর যেমন বলেছেন, দীর্ঘদিনের একাধিক চুক্তি মেনেই গুলি চালায় নি ভারতীয় সেনাবাহিনী।

***

একাধিক সামরিক আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানতে পেরেছে যে ভারতীয় সেনার যে বাহিনীর সঙ্গে চিনাদের সংঘর্ষ বাঁধে, সেই দলের অধিকাংশের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিল। এটাই নিয়ম, যা বোঝা যায় সাম্প্রতিক কালে দুই দলের মুখোমুখি হওয়ার কিছু ছবি এবং ভিডিও দেখলে। দেখা যায় যে সৈন্যদের কাছে হাতিয়ার রয়েছে, তবে বন্দুকের নল মাটির দিকে তাক করা। এটি স্থানীয় নিয়ম মেনেই করা, যাতে দুর্ঘটনা বশত গুলি না চলে বা বন্দুকের নল একে অপরের দিকে তাক করা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়।

যদিও সেরকম কড়া বিধিনিষেধ নেই, তবু আধিকারিকরা বলছেন যে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই নিয়মকানুন, এবং বর্তমানে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় এগুলি নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করাই রীতি। যেহেতু ১৯৬২ সালের পর ভারত-চিন সীমান্তে একটি গুলিও চলে নি, সেহেতু উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে 'নো ফায়ারিং'-এর রীতি গেঁথে দেওয়া হয়েছে সৈনিকদের মনে।

আরও পড়ুন: চৌ এন লাইয়ের প্রস্তাব, নেহরুর প্রত্যাখ্যান ও তা থেকে শিক্ষা

এই আবহে আগ্নেয়াস্ত্র বাদে আর যে কোনোরকম অস্ত্রের ব্যবহারই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে সেনার কাছে, এবং পূর্বে কিছু সংঘর্ষে এগুলি ব্যবহৃতও হয়েছে। যদিও এইসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেকে, লাঠিসোঁটা অথবা পাথরের ঘায়ে এর আগে কারোর মৃত্যু হয় নি। তবে এইসব বিকল্প অস্ত্র ব্যবহারের হিংস্রতা ক্রমশ বেড়েছে, যেমনটা দেখা যায় ৫-৬ মে'র প্যাংগং সো-র সংঘর্ষে, যেখানে আহত হন ৭০ জনেরও বেশি ভারতীয় সৈনিক।

সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রকাশ, ওই এলাকায় মোতায়েন সৈন্যদের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ বর্ম এবং 'অ্যান্টি-রায়ট' সরঞ্জামের বরাত দেয়, যা থেকে আরও একবার স্পষ্ট যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার আশেপাশে গোলাগুলি নিষিদ্ধই। এই পরিস্থিতিতেই ঘটে সোমবারের সংঘর্ষ, যদিও সেনাবাহিনীর সাধারণ নিয়ম বলে, নিজেদের বা সতীর্থদের প্রাণরক্ষার্থে গুলি চালানো অনুমোদিত।

এ বিষয়ে নানা মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং জানতে চেয়েছেন, কয়েক ঘণ্টার সংঘর্ষেও কেন একবারও গুলি চালানো সমীচীন মনে করলেন না বাহিনীর কোনও কমান্ডিং অফিসার। সেনাবাহিনীর কিছু প্রাক্তন অফিসার এমনও বলেছেন যে পরিস্থিতি যা ছিল, তাতে কামান দিয়ে তোপ দাগলেও তা নিয়মানুযায়ী সম্পূর্ণ অনুমোদিত।

তবে বর্তমান অফিসাররা বলছেন যে বিষয়টির অন্য একটি দিকও আছে। ভারতীয় ও চিনা সৈন্যদের প্রবল হাতাহাতির গণ্ডগোলে নিজেদের লোককে বাঁচিয়ে গুলি চালানো অত্যন্ত কঠিন হতো। তাঁদের দাবি, সেই কারণেই সোমবার নিজেদের কমান্ডিং অফিসার এবং আরও ১৯ জনকে নিহত হতে দেখেও, বা ১০ জন সতীর্থকে বন্দী হতে দেখেও, গুলি চালায় নি ভারতীয় ফৌজ।

***

জটিল সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রায় দেওয়া কঠিন, বিশেষ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকলে। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যে সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে ঘটনার গতিপ্রকৃতি, যার দায় বর্তাবে ভবিষ্যতের ওপর। ভারতীয় ফৌজের গুলি না চালানোর সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ যাই থাক, তার ফলে আর এগোতে পারে নি পরিস্থিতি। তবে এও অনস্বীকার্য যে দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের নিয়ম নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য থেকে গেল বড় ধরনের প্রশ্নচিহ্ন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

india china standoff
Advertisment