Lakshadweep Culture: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক সফর লাক্ষাদ্বীপকে দেশবাসীর আলোচনায় টেনে এনেছে। আরব সাগরে কেরল উপকূল থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে, মনোরম দ্বীপগুলোকে দীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় পর্যটকদের কাছে 'লুকোনো রত্ন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে এই দ্বীপগুলো অনন্য। যদিও এর অধিকাংশ অধিবাসী মুসলিম। কিন্তু, লাক্ষাদ্বীপের ইসলাম চর্চা ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ভিন্ন। এখানে দ্বীপবাসীরা ইংরেজির পাশাপাশি মালয়ালি, আরব, তামিল এবং কন্নড়ে কথা বলেন। তাঁদের জাতিগত, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কে বিভিন্নতার মধ্যেও ঐক্য গড়ে তুলেছেন লাক্ষাদ্বীপ অধিবাসীরা।
- লাক্ষাদ্বীপে আজও প্রাক-ইসলামি যুগের সংস্কৃতি টিকে আছে।
- ভারতের এই দ্বীপপুঞ্জের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী।
- ঔপনিবেশিক প্রভাব এবং সংস্কারবাদী মুসলিম আন্দোলনের প্রভাব এখানে পড়েনি।
প্রাক-ইসলামি হিন্দু সমাজ
ইসলামিক স্টাডিজের পণ্ডিত অ্যান্ড্রু ডব্লিউ ফোর্বস বলেছেন যে, 'এতে সামান্যই সন্দেহ থাকতে পারে যে লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জে প্রথম বসতি স্থাপনকারীরা মালাবারের নাবিক। তাঁরা সম্ভবত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।' ফোর্বস একথা লিখেছেন, লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসের উৎস, ২০০৭-এ। তিনি জানিয়েছেন, লাক্ষাদ্বীপবাসীদের মধ্যে ভাষাগত ঐতিহ্যেও প্রাক-ইসলামি হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব স্পষ্ট। ফোর্বসের দাবি, মালাবার থেকে লাক্ষাদ্বীপে আসার বড়সড় ঘটনাটি ঘটেছিল সপ্তম শতাব্দীতে। শুরুটা কবে হয়েছিল বলা অসম্ভব। যাইহোক, যাঁরা লাক্ষাদ্বীপে পৌঁছেছিলেন, তাঁরা ছিলেন মূলত মালাবারি হিন্দু। লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জে বিদ্যমান বর্ণ কাঠামো সম্ভবত সেই সময়কার। পাশাপাশি, বহু সমাধিস্থ মূর্তি আবিষ্কার, রামের প্রশংসা, সাপের পূজার ঐতিহ্যবাহী গানের মধ্যে দ্বীপগুলোতে একটি প্রাক-ইসলামি হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়।
দ্বীপবাসীরা কেন ইসলাম গ্রহণ করলেন?
ফোর্বস বিশ্বাস করে যে আরব এবং মালাবার উপকূলের মধ্যে ভ্রমণকারী আরব বণিক এবং নাবিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে দ্বীপবাসীরা দীর্ঘ সময় পরে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। লাক্ষাদ্বীপে ইসলামি প্রভাব মালাবারের মাপিলা সম্প্রদায়ের মাধ্যমে না-হয়ে আরবদের মাধ্যমে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ফোর্বস উল্লেখ করেছেন, 'লাক্ষাদ্বীপের অধিবাসীরা মূল ভূখণ্ডের ম্যাপিলাসের তুলনায় আরবি ভাষার বৃহত্তর সংমিশ্রণে মালয়ালম ভাষায় কথা বলেন। মালয়ালি লিপির পরিবর্তে আরবি ভাষায় মালয়ালম লিখতে পারেন।' ইতিহাসবিদ মাহমুদ কুরিয়া ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, 'উত্তর ভারতের উলটো পথে হেঁটে লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম ছড়াতে কম বেগ পেতে হয়েছিল। এই অঞ্চলে ইসলামের প্রবর্তন হয়েছিল মূলত বাণিজ্যের হাত ধরে।'
আরও পড়ুন- দ্বন্দ্ব চরমে, তবুও ভারত-মালদ্বীপের একে অপরকে প্রয়োজন, কারণটা কী?
মূল ভূখণ্ড থেকে ভিন্ন সংস্কৃতি বিকশিত
ষোড়শ শতকে, লাক্ষাদ্বীপ কান্নুরের আরক্কাল রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই রাজবংশ হল কেরলে শাসন করা একমাত্র মুসলিম রাজবংশ। রাজ্যটি প্রায়শই ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ত। যাদের কাছে লাক্ষাদ্বীপকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল মর্যাদার বিষয়। ইতিহাসবিদ মনু পিল্লাই ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, 'পর্তুগিজরা দ্বীপটি দখল করার জন্য জোরালো চেষ্টা চালিয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তারা শতশত স্থানীয়দেরকে হত্যা করেছিল। কারণ পর্তুগিজরা কোলাথিরি এবং আরক্কালের মত মূল ভূখণ্ডের শাসকদের সঙ্গে শর্তে এসেছিল যে দ্বীপগুলোতে তাদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকবে। এই সুরক্ষা ব্রিটিশ শাসনের সময়ও অব্যাহত ছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে আরক্কাল রাজ্য মালাবারে তার বেশিরভাগ জমি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটেনের রানির কাছে নতজানু হওয়ার বিনিময়ে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত লাক্ষাদ্বীপের একটি অংশ ধরে রেখেছিল। যার জেরে উপনিবেশবাদের প্রভাব ভারতের মূল ভূখণ্ডের তুলনায় লাক্ষাদ্বীপে কম পড়েছে। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার জেরে লাক্ষাদ্বীপের সংস্কৃতি এবং সমাজ ভারতের বাকি অংশের তুলনায় খুব কমই বিবর্তিত হয়েছে। কোনও একটি সাংস্কৃতিক প্রভাব এই দ্বীপে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। আর, সেই কারণেই লাক্ষাদ্বীপে তিনটি প্রধান ভাষা হল: মালায়ালাম, জাজারি এবং মাহল।
মাতৃতান্ত্রিক সমাজ
যা সত্যিই লাক্ষাদ্বীপের ইসলামিক সমাজকে অনন্য করে তুলেছে, তা হল মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। এখানে বংশ এবং সম্পত্তি মায়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। নৃবিজ্ঞানী লীলা দুবে 'ম্যাট্রিলিনি অ্যান্ড ইসলাম: রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটি ইন দ্য লাক্ষাদ্বীপস' (১৯৬৯)-এ লিখেছেন লাক্ষাদ্বীপ, 'ইসলামের আদর্শের সঙ্গে বেমানান মাতৃতান্ত্রিক সমাজ'-এ বিশ্বাসী। মাতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনু পিল্লাই, কেরলের সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের সম্পর্কের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, 'আমিনি, কালপেনি, আন্দ্রোট, কাভারত্তি এবং আগাট্টি হল প্রাচীনতম দ্বীপ। যা একসময় জনবসতি ছিল। এখানে কিছু পরিবার দাবি করে যে তারা মূল ভূখণ্ডের নায়ার এবং নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া ব্যক্তিদের বংশধর।' মাহমুদ কুরিয়া অবশ্য বলেছেন যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কেবল কেরলেই নয়। মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তানজানিয়া প্রভৃতি ভারত মহাসাগর অঞ্চলের মুসলমান সমাজেও রয়েছে। কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রধান ড. এনপি হাফিজ মহম্মদ ২০২১ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, 'দ্বীপবাসীরা বিশ্বাস করেন যে নবি তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজার সঙ্গে মা-সন্তানের মত ব্যবস্থায় বসবাস করতেন। এটি তাঁদের মাতৃত্বকালীন অনুশীলনের ধর্মীয় অনুমোদন।' যার অর্থ হল, শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক প্রভাব এড়ানোই নয়, লাক্ষাদ্বীপে ১৯৩০-এর দশকে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের সংস্কারবাদী মুজাহিদ আন্দোলনের প্রভাবও পড়েনি।