Advertisment

লকডাউনে ভারতের পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার তাড়া- বিশেষজ্ঞের অভিমত

সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ হল, ভুল তথ্যের কারণে এই পরিমাণ ঘরে ফেরার হুড়োহুড়ি পড়েছে। আমি এ কথার সঙ্গে সহমত নই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Lockdown, Migrant Labour

পুনে মুম্বই রোড দিয়ে গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে বাড়ির পথে পরিযায়ী শ্রমিক (ছবি- নরেন্দ্র ভাস্কর)

তারিক থাচিল ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণার বিষয় হল ভারতের যথেচ্ছ নগরায়ন এবং অন্তর্বর্তী পরিযান। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বিষয় ছিল দেশের চক্রাকার অন্তর্বর্তী পরিযায়ী শ্রমিক।

Advertisment

পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, তা কি নিরাপদ?

অন্য দেশ ও সমাজের তুলনায় ভারতের শহরগুলিতে অভিবাসী শ্রমিকদের বৈশিষ্ট্য কী?

ভারতের শহরগুলির পরিযায়ী শ্রমিকেরা এবং ব্যাপকাংশের শ্রমিকেরা এখন সংবাদে উঠে এসেছেন। এঁদের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, অন্তর্বর্তী অভিবাসন, এসংগঠিত থাকা এবং চক্রাকার হওয়া। প্রথমত, এই শ্রমিকরা ভারতের মধ্যেকার, পরিযানের গবেষণার অধিকাংশই জুড়ে থাকে যে আন্তর্জাতিক পরিযায়ীরা, তেমন নন।

২১ দিন পর কি সীমিত লক ডাউনের পথে যাবে দেশ?

দ্বিতীয়ত, এঁরা অসংগঠিত হবার কারণেই এঁদের কোনও চুক্তি নেই। বহু পরিযায়ী শ্রমিকরা দিন মজুর হিসেবে (যেমন নির্মাণকাজে যুক্ত বেলদার) বা স্ব রোজগারি (যেমন ফুটপাথের বিক্রেতা)। এঁদের রোজগারের প্রকৃতিটাই অনিশ্চিত, এবং লকডাউনের মত হঠাৎ কাজ বাতিল হলে তার জন্য এঁদের কোনও সুরক্ষা থাকে না।

তৃতীয়ত, অধিকাংশ অভিবাসীদের কোনও নির্দিষ্ট শহর নেই বাস করবার জন্য। খরচসাপেক্ষ এবং আতিথ্যহীন শহরগুলোতে তাঁরা বাধ্যত পরিবারহীন থাকেন। ফলে তাঁরা বছরভর বিভিন্ন শহর ও গ্রামে ঘুরতে থাকেন, তাঁদের শিকড় অতি গভীরে গ্রামগুলিতে নিহিত থাকে। লকডাউন ঘোষণার পর তাঁদের মরিয়া হয়ে নিজের এলাকায় ফেরার চেষ্টাকে এই প্রেক্ষিত থেকে বুঝতে হবে।

চক্রাকার এবং অসংগঠিত শ্রমিকদের স্থায়ী সংগঠিত শ্রমিকদের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যাঁরা শিল্পবিপ্লবের জেরে খামার থেকে কারখানায় অর্থাৎ শহরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তবে চক্রাকার পরিযান ভারতেই একমাত্র দেখা যায় এমন নয়। অন্তর্বর্তী পরিযায়ীরা আন্তর্জাতিক পরিযায়ীর তুলনায় সংখ্যা বেশি, অনুপাতের হিসেবে ৩ : ১। বহু অন্তবর্তী পরিযায়ীরাই অসংগঠিত অর্থনীতিতে যুক্ত।

বাংলাদেশ থেকে মোজাম্বিকের মত সবা জায়গাতেই এই ধরনের পরিযায়ী জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ক্ষেত্রে এঁদের সমস্যা জননীতির আকস্মিকতা।

ভারতের অর্থনীতিতে এঁদের অবদান কী? এঁদের কি যথাযথ ও নিখুঁতভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে?

সোজা কথায়, না। দুটো কারণে। প্রথমত যেরকম আনুষ্ঠানিকতাহীন ভাবে এঁদের নিয়োগ করা হয়, তাতে এঁদের অর্থনীতিতে অবদান তো দূর, এই জনসংখ্যা কত তারই কোনও নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়া যায় না। যেসব ক্ষেত্রে এই চক্রাকার পরিযায়ীদের মূলত কাজে লাগানো হয়, তার ভিত্তিতে এঁদের অবদানের একটা অনুমানমাত্র আমরা করতে পারি।

করোনা সংক্রমণ আটকাতে সামাজিক দূরত্ব নীতি কতটা কার্যকর?

আরও সূক্ষ্ণ গবেষণায় দেখা গিয়েছে এই ধরনের পরিযায়ীরা প্রভাবশালী ও নির্মাণশিল্প, ইটভাটা, খনি, হোটেল ও রেস্তোরাঁ এবং ফুটপাথের বিক্রির মত ক্ষেত্রে এঁরাই মূল চালিকা। এর মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্র ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং ভারতের জিডিপির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এসব ক্ষেত্র থেকে আসে।

সরকারি খতিয়ানের কথা ছাড়াও এই সব পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদানের কথা স্বীকার করবার ব্যাপারে সমাজের একটা বড় অংশের অনীহা রয়েছে। এঁরা অত্যাবশকীয় পরিষেবা দিয়ে থাকেন, যে কাজ শহরবাসীরা চান হোক, কিন্তু নিজেরা করতে রাজি নন। পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলবার সময়ে আমাকে অনেকই বলেছেন, তাঁদের শহুরে নিয়োগকর্তা, মধ্যবিত্ত দোকানদার ও গৃহস্থ, পুলিশ তাঁদের কীভাবে হেনস্থা করে থাকেন। এই লকডাউন থেকে আমি একটা রুপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছি। এঁদের অনুপস্থিতি ও অবদান এবার অনুভূত হচ্ছে।

ভারতের শহরাঞ্চলে কত পরিমাণ পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন বলে আপনার অনুমান? এঁদের সাধারণ আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থাই বা কীরকম?

এটা একটা সহজ প্রশ্ন, যার উত্তর জটিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সংখ্যাটা ঠিক কত সে ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন কারণে সহমত হতে পারিনি। অনেক সরকারি তথ্যেই পরিযায়ীর যে সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে, তা থেকে এই পরিযায়ী চক্রাকার শ্রমিকদের অস্থায়ী এবং ভ্রমণশীল চরিত্র ধরা পড়ছে না।

উদাহরণ হিসেবে ভারতের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে ৬৪ তম দফায় পরিযায়ীদের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং দেখেছে সারা ভারতে স্বল্পস্থায়ী পরিযায়ীর সংখ্যা ১ থেকে ২ শতাংশ। এই হিসেবে স্বল্পমেয়াদি পরিযায়ীর সংখ্যা ১৩ থেকে ২৬ মিলিয়ন হবার কথা। কিন্তু যে সংখ্যাটা দেখানো হচ্ছে তা প্রভূত কম হবারই সম্ভাবনা।

তাবলিগি জামাত কী, কেমন করে চলে এ সংগঠন?

এনএসএস স্বল্পমেয়াদি হিসেবে তাদের কথাই বলেছে যারা গত বছরে ৬ মাস কাজের সুবাদে অন্য জায়গায় ছিল। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই দেখা যায় একজন পরিযায়ী পুরো বছরকালটাই শহরে কাটান, বাড়ি ফেরেন উৎসবে, ফসল কাটার সময়ে বা পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।

এছাড়াও এই পরিযায়ীরা শগরে এমন অস্থায়ী পরিবেশে কাজ করেন ও বাস করেন, এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে ঘোরাফেরা করেন যে কোনও বাসস্থানভিত্তিক সার্ভেতে তাঁদের নাম ওঠার কথা নয়।

বিকল্প তথ্য বলছে ভারতে এ ধরনের পরিযায়ীর সংখ্যা ব্যাপক। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে গ্রামীণ জনতার অর্ধেকের বেশি অদক্ষ শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে থাকেন, এবং তার বেশিরভাগটাই শহরে। কোনও কোনও গবেষকের পরিসংখ্যান অনুসারে নির্মাণক্ষেত্র সহ পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ১২০ মিলিয়ন। সত্যিটা এর মাঝামাঝি হতে পারে, কিন্তু কোনও ভাবেই ১০ মিলিয়নের কয়েক গুণের কম নয়।

চক্রাকার পরিযায়ীদের গড় আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে এর চেয়ে বেশি সহমত রয়েছে। বেশিরভাগ গবেষণাই বলছে আর্থিকভাবে এঁরা পিছিয়ে থাকা। আমার নিজের সার্ভেও তেমনটাই বলছে।

আমি ৩০১৮ জন পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা দিন মজুর হিসেবে কাজ করেন এবং ১২০০ পরিযায়ী যাঁরা ফুটপাথে বিক্রেতার কাজ করেন তাঁদের নিয়ে সার্ভে করেছি। এঁরা দিল্লি ও লখনউয়ের। আমার সার্ভের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এঁদের জাত ও ধর্ম ভিন্ন হলেও এঁরা সকলেই আর্থিক অনগ্রসর। এঁদের ২৭ শতাংশ তফশিলি জাতিভুক্ত, ৪৪ শতাংশ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির, ১৮ শতাংশ উচ্চবর্ণীয় এবং ১২ শতাংশ মুসলিম।

এঁদের ৭৫ শতাংশের দৈনিক আয় ২ ডলারের কম। ৭৭ শতাংশের কোনও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা নেই, ৭৪ শতাংশের গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। অর্ধেকের বেশি ঋণগ্রস্ত। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে জাতি ও ধর্মের উপর আর্থিক অবস্থা অনেকটাই নির্ভর করে, সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই আর্থিক সমতা লক্ষ্যণীয়।

সরকার লকডাউন ঘোষণা করতেই দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফেরার চেষ্টা করতে শুরু করায় কি আপনি বিস্মিত? এটা কি আটকানো যেত ?

একেবারেই বিস্মিত নই। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ হল, ভুল তথ্যের কারণে এই পরিমাণ ঘরে ফেরার হুড়োহুড়ি পড়েছে। আমি এ কথার সঙ্গে সহমত নই। শীর্ষ আদালতের এরকম দাবি করার পিছনে যদি এমন কোনও তথ্য থাকে যা আমার পাবার কথা নয়, তাহলে ঠিক আছে। তা না হলে এই ফেরার তাড়না সবচেয়ে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া।

এ ঘটনায় তাঁরাই বিস্মিত হবেন যাঁদের এ গোষ্ঠী সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই।

আমার নিজের সার্ভে বলছে অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরা ভাড়া করা বদ্ধ ঘরে থাকেন কিংবা ফুটপাথে ঘুমোন, শহরে রেশন সংগ্রহ করবার মত কোনও নথি তাঁদের কাছে থাকে না, শহরে পরিবারের কেউ নেই এবং চালানোর মত সঞ্চয়ও তেমন নেই।

এঁরা পুলিশ ও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের হেনস্থার শিকার হয়ে থাকেন। এঁদের দেখা হয় অপরিচ্ছন্ন, উপদ্রব, মায় অপরাধী হিসেবে।

লকডাউন শুরু হলে তাঁদের শহরে থাকার সবচেয়ে বড় কারণটাই নাকচ হয়ে যায়- শহরের কাজ। এরপর নভেল করোনাভাইরাসের যা চরিত্র, তাতে পরিযায়ীরা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত যে তাঁরা ফের শহরে কাজের সুযোগ আদৌ পাবেন কিনা। তাহলে কেন তাঁরা পরিবার থেকে দূরে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে রইবেন!

হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা এই জনগোষ্ঠীকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা ভেবে দেখাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর ও মানবিক দিক।

দীর্ঘকাল লকডাউন চললে এই জনগোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের পরিবার থেকে দূরে জীবন কাটাবেন সে কথা ভাবা প্রয়োজন ছিল।

দ্বিতীয়ত, পরিযায়ী শ্রমিকরা যেখানে রয়েছেন সেখানে থাকা এবং তাঁদের নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবার মধ্যে কোনটা বেশি জরুরি তা স্থির করা উচিত ছিল। এর কোনওটাই ঠিকমত পালিত হয়নি।

এই শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে কী প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন? তাঁরা কি গ্রামে স্বাগত?

আমি যেসব পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে গ্রামে গিয়েছি চাঁদের আমি পরিবারের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনাই পেতে দেখেছি। তবে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। একজন পরিযায়ী আমাকে বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের লোকেরা তাঁর সঙ্গে এটিএমের মত ব্যবহার করে থাকেন, কত টাকা এনেছেন সে নিয়েই শুধু আগ্রহ। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ফারাক দেখা যায় গ্রামের জাতি ও শ্রেণিগত উঁচুনিচু বিভেদে।

যেমন দলিত পরিযায়ীরা অভিযোগ করেছেন তাঁদের গ্রামে তাঁরা যদি নতুন জামা বা পরিবারের জন্য উপহার নিয়ে ফেরেন, তাহলে তাঁদের এই উন্নতির কারণে উচ্চবর্ণীয়দের হাতে হেনস্থার শিকার হতে হয়।

যেসব ভারতীয়রা পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে যান এবং যাঁরা দেশের মধ্যে অন্য জায়গায় যান, এঁদের দু দলের মধ্যে ভারত রাষ্ট্র ও সমাজ ভিন্ন ব্যবহার করে কেন?

আমি নিশ্চিত যে পাঠকেরা এর কারণ জানেন। স্বাভাবিকতা যখন সংকটের মুখে পড়ে রাষ্ট্র তখনই আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নাগরিকদের দিকে তাকায়। আমেরিকায় বসবাসকারী ভারতীয় শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর।

এই ডায়াস্পোরাটিকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, তাদের নিয়ে উৎসব করা হয়ে থাকে, যেমনটা আমরা সম্প্রতি হাউস্টনে হাউডি মোদির সমাবেশে দেখেছি।

উল্টোদিকে গরিব পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান স্বীকার করার কোনও পদক্ষেপও আমরা দেখিনি। তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার বর্ধনের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus
Advertisment