একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে স্থির করবেন কোন এক্সিট পোল কতটা নির্ভরযোগ্য? কার দেওয়া সংখ্যাকে তাঁরা পছন্দের তালিকায় রাখবেন, আর কার নম্বরকেই বা ফেলে দেবেন আবর্জনার আস্তাঁকুড়ে! আজকাল কেউ কেউ কোন সংস্থা এক্সিট পোল পরিচালনা করেছে বা কোন চ্যানেলে তা দেখানো হয়েছে, তার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেন। কেউ কেউ আবার কতজনের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তা দেখে ঠিক করেন তা নির্ভরযোগ্য কিনা। তাঁদের কাছে যত বেশি সংখ্যক লোকের উপর সমীক্ষা হবে, তত বেশি নির্ভরযোগ্য।
বাস্তবত এক্সিট পোলের যাথার্থ্য বিচারের জন্য এর কোনওটিই ঠিক সূচক নয়। তাহলে প্রশ্ন হল, কী করে একজন এই সংখ্যাগুলিকে পাঠ করবে এবং তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের কি এক্সিট পোলের উপর নির্ভর করা উচিত?
আরও পড়ুন, বাংলায় বিজেপির বিরাট উত্থান, ধাক্কা তৃণমূলে, মত এক্সিট পোলের
এক্সিট পোলে যেসব সংখ্যা দেখা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণত নাকচ করে দেওয়া যায় না, আবার পুরোপুরি বিশ্বাস করেও ফেলা চলে না। কিছু ভাল এক্সিট পোল যেমন রয়েছে, তেমনই কিছু এক্সিট পোল রয়েছে, যা তত ভাল নয়।
একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রকে ভিত্তি করে বড় সংখ্যক ভোটারদের সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্যরাশির উপর নির্ভর করে। সে সাক্ষাৎকার টেলিফোনে নেওয়া হয়েছে, নাকি মুখোমুখি বলে নেওয়া হয়েছে, পেন ও পেন্সিল ব্যবহার করা হয়েছে অথবা আইপ্যাড বা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করা হয়েছে, তা ভিন্ন প্রশ্ন।
এই পদ্ধতি নতুন কিছু নয়, ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় লোকসভা ভোটের সময়েও এ পদ্ধতি গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু সর্বোত্তম অনুমানও কোনও কোনও সময়ে প্রয়োজনীয় প্রণালীবিজ্ঞান এড়িয়ে ফেলে। একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্র ছাড়া তথ্যরাশি সুসঙ্গত ভাবে সংগৃহীত হতে পারে না এবং নিয়মানুগ ভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না, যার মাধ্যমে ভোট শেয়ারের হিসাব ঠিকঠাক ভাবে করা যেতে পারে।
নমুনার আকার, প্রতিনিধিত্ব
১৯৫৭ সালে এক্সিট পোল শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত একটি বিষয়ে ব্যাপক বদল ঘটেছে, তা হল স্যাম্পেল সাইজ বা নমুনার আকার। জাতীয় স্তরে একসময়ে ২০-৩০ হাজার সংখ্যাটাও যথেষ্ট মনে হত। সে দিন আর নেই। এ দেশে যাঁরা সেফোলজি শুরু করেছিলেন, সেই প্রণয় রায় বা যোগেন্দ্র যাদবরাও ১৯৮০- শুরু দিক থেকে ১৯৯০-এর শেষ দিক পর্যন্ত এই সংখ্যক নমুনা নিয়েই কাজ করতেন। সিএসডিএস ১৯৯৬ সালে একবার নলিনী সিংয়ের সঙ্গে দূরদর্শনে এক্সিট পোল করেছিল, সেবার স্যাম্পেল সাইজ ছিল ১৭,৬০৪।
আরও পড়়ুন, বিপুল আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফের এনডিএ, বলছে এক্সিট পোল
২০১৯ সালের বিভিন্ন এক্সিট পোলে দেখা যাচ্ছে স্য়াম্পেল সাইজের পরিমাণ কয়েক লক্ষ। বড় আকারের নমুনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তার চেয়েও জরুরি বিভিন্ন ধরনের ভোটারের প্রতিনিধিত্ব। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলির চাপের কারণেই আরও বেশি সংখ্যার দিকেই সকলে ধাবিত হচ্ছে।
আগে প্রতিযোগিতা হত কোন চ্যানেল সবার আগে এক্সিট পোল প্রকাশ করছে, এখন গোটা বিষয়টা দাঁড়িয়ে থাকছে বৃহত্তম স্যাম্পেল সাইজের ওপর।
সুইং মডেল এবং জটিলতা
ভোট-পূর্ব সমীক্ষা, ভোট পরবর্তী সমীক্ষা এবং এক্সিট পোল পরিচালনার আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আসন সম্পর্কিত পূর্বানুমান নির্ভর করে সুইং মডেলের ওপর - বর্তমান ভোট বিভিন্ন দল ও জোটের ভোট শেয়ার নিয়ে অনুমান করে কিছু বাছাই উত্তরদাতাদের সাক্ষাৎকারের উপর নির্ভর করে, এবং আসন সংখ্যার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় আগের ভোটের ফলের উপর নির্ভর করে।
আরও পড়ুন, এক্সিট পোল মানি না, গর্জন মমতার
ভারতের যা বৈচিত্র্য়- স্থানিক, জাতিগত, ভাষাগত, শিক্ষাগত, আর্থিক বিবিধ প্রকারের বৈচিত্র্যের কথা মাথায় রাখলে ভোট শেয়ার সম্পর্কিত অনুমান করা যথেষ্ট শক্ত, কারণ এই সবকটি বিভিন্নতাই ভোটদানের প্রকৃতিতে প্রবাব ফেলে। এই বিভিন্ন শ্রেণির যদি অতিরিক্ত বা অতি কম প্রতিনিধিত্ব থাকে তাহলে ভোটশেয়ারের যথার্থ অনুমানে তা প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
সমস্যা আরও রয়েছে। আগেকার ভোট শেয়ারে যেহেতু সুইং মডেল প্রয়োগ করা হয়েছিল, এবার দুটি ভোটের মাঝে যদি জোটে বদল ঘটে বা কোনও পার্টিতে ভাঙন ঘটে বা একাধিক পার্টি যদি সম্মিলিত হয়ে য়ায় তাহলে ভোটশেয়ার অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের ভোটে জেডিইউ বিজেপির সঙ্গী ছিল না এবং তারা বিহারে ১৫.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এনডিএ পেয়েছিল ৩৮.৭ শতাংশ ভোট এবং ইউপিএ পেয়েছিল ১৫.৭ শতাংশ ভোট।
এবার জোটে বদল ঘটেছে এবং জেডিইউ এখন এনডিএ-র অংশ। ২০১৪ সালে জেডিইউ এনডিএ-র বিরুদ্ধে লড়েছিল, এবার জেডিইউ যদি ২০১৪ সালে এনডিএ-র সঙ্গে থাকত, তাহলে এনডিএ-র ভোট শেয়ার কী হত, তা হিসেব করা শক্ত। সহজ ভাবে বললে, এনডিএ-র ৩৮.৭ শতাংশ ভোট নিয়ে ২০১৪ সালে যদি ৩১টি আসন পেতে পারে, তাহলে ভোট শেয়ারের বদলের ফলে আসনসংখ্য়া কত কমবে বা বাড়বে! এটা এক রাজ্যের কথা, এবার ২৯ টি রাজ্যের রাজ্যওয়ারি পূর্বাভাস ও তার জটিলতার কথা ভাবুন।
কতটা সর্বাঙ্গীণ?
গণনার প্রক্রিয়া সময় ও শ্রমসাপেক্ষ। আসন অনুযায়ী পূর্বাভাস করা হলে তা সর্বাঙ্গীণ বলে গণ্য। এরকম ক্ষেত্রে স্যাম্পেল সাইজের পরিমাণ কয়েক লাখ হয়ে থাকে। কোনও কোনও সংস্থা কম সময় এবং লোকবল ব্যয় করে অধিক লাভের জন্য গণনা প্রক্রিয়ায় নানা রকম নতুনত্বের আশ্রয় নেন।
সকলেই দাবি করে থাকেন তাঁরা সমস্ত আসনেই পোলিং করেছেন, তবে বাস্তবত তেমনটা সব সময়ে প্রয়োজন হয় না - বারাণসীতে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বা গান্ধীনগরে, যেখানে অমিত শাহ ভোটে লড়ছেন সেথানে অর্থ ও শক্তি কেন খরচ করা হবে! ভাল করে রাজ্যওয়ারি সমস্ত কেন্দ্র গুলির দিকে দেখলে বোঝা যাবে, কোনও এক্সিট পোল না করেই সম্পূর্ণ যথাযথ ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে এমন বেশ কিছু কেন্দ্র রয়েছে। এই বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে গণনার প্রক্রিয়া মেলানোর পর সমীক্ষা প্রয়োজন হয় কিছু দুরূহ কেন্দ্রে যেখানে সুইং হতে পারে। সাবেকি পদ্ধতি ব্যবহার করে ভোটশেয়ার সম্পর্কিত আভাসের ফলে ভোটদানের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু গণনাপ্রক্রিয়া অবলম্বন করা হলে ভোট শেয়ার সম্পর্কে আভাস পাওয়া শক্ত এবং ভোটদানের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ তখন কেবল স্বপ্ন মাত্র।
প্রতিফলনের সময় এসে গেছে
২০১৯ সালের এক্সিট পোল প্রকাশিত হয়ে গেছে। প্রশ্ন হল, এই সংখ্যাসমূহ কি ২০০৪ সালের মতই নাকি ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি যথাযথ! ২০০৪ সালে সমস্ত এক্সিট পোলে এনডিএ-র সহজ জয় দেখানো হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল কংগ্রেস।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা জানি না, কোন সংখ্যাটাকে সিরিয়াসলি গ্রহণ করব, কোন এক্সিট পোল অন্যগুলির চেয়ে বেশি ঠিকঠাক।
(অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার সেন্টার ফর ডেভেলপিং স্টাডিজের বর্তমান ডিরেক্টর। মতামত ব্যক্তিগত)
Read the Full Story in English