লেখক হেমন্ত আদলাখা
(নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চিনা ভাষা পড়ান। দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ চাইনিজ স্টাডিজ (ICS)-এর ভাইস চেয়ারপারসন এবং অনারারি ফেলো।)
Maldives-China: মালদ্বীপের আয়তন ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৫ লক্ষেরও বেশি। তবে এই সামান্য আয়তন এবং জনসংখ্যার জন্য নয়। ভারত মহাসাগরে তার কৌশলগত অবস্থানের জন্যই মালদ্বীপের মূল গুরুত্ব। আর এই কারণেই মালদ্বীপের ওপর আধিপত্য জমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত, চিন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মালদ্বীপের এই অবস্থান অবশ্য নতুন কিছু নয়। তেমনই, তার ওপর আধিপত্য জমানোর চেষ্টাও নতুন না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। ব্রিটিশরা মালদ্বীপকে ব্যবহার করে বাণিজ্যিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে জোর দিয়েছিল।
- শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে জোর দিয়েছেন।
- মুইজ্জুই মালদ্বীপের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ভারতের বদলে চিনে তাঁর প্রথম সফর করলেন।
- চিন দাবি করে, মালদ্বীপের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কয়েক শতাব্দী পুরোনো।
চিন-মালদ্বীপ সম্পর্ক
চীন মালদ্বীপকে ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে দাবি করে। এমন একটি সম্পর্ক দাবি করে যা তাং রাজবংশের (৭ম শতক) সময় থেকে শুরু। কয়েক শতাব্দী আগের প্রাচীন সিল্ক রুটের সঙ্গে যার যোগাযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে, চিনের পণ্ডিতরা বিখ্যাত মিং রাজবংশের চিনা নৌযানবিদ ঝেং হি-এর সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। ওই চিনা নৌযানবিদ যথাক্রমে ১৪১২ এবং ১৪৩০ সালে দু'বার মালদ্বীপ সফর করেছিলেন। চিনা সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করে যে, মালদ্বীপের রাজা ইউসুফও ১৪১৭ সালের দিকে তিনটি ভিন্ন অনুষ্ঠানে চিনে দূত পাঠিয়েছিলেন। যাইহোক, সেসব পুরোনো কাসুন্দি। সমসাময়িক যুগে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন এবং মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে।
শি-এর জমানায় সম্পর্ক বৃদ্ধি
চিনের তরফে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং এই শতাব্দীর প্রথম দশকে, প্রধানমন্ত্রী ঝু রংজি, কয়েকজন সিনিয়র সিসিপি (কমিউনিস্ট পার্টি অফ চিন) পলিটব্যুরোর সদস্য মালদ্বীপ সফর করেন। শি জিনপিং চিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, দুই দেশ ২০১৪ সালে ভবিষ্যতের জন্য সম্পর্ক স্থাপনে জোর দেন। চিনের রাষ্ট্রপ্রধান মালদ্বীপ সফর করেন। শির জমানায়, দুই দেশের সম্পর্কের দ্রুত অগ্রগতি ঘটে। জিনপিঙের নতুন উদ্যোগ, 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড' চিন এবং মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে। মালদ্বীপ, ওবিওআর-এ যোগদানকারী দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশের স্বীকৃতি পায়। এই ওবিওআর-এ কে এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বলা হচ্ছে। মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পরপরই বেজিং যান। ৮-১২ জানুয়ারি, তিনি বেজিং সফর করেন। এই সফর, ২০১৪ সালে মালেতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের ঐতিহাসিক সফরের দশম বার্ষিকী হিসেবে চিনে পালিত হয়।
মুইজ্জু জমানায় 'নতুন শুরু'
মুইজ্জুই মালদ্বীপের প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের জন্য ভারতের পরিবর্তে চিনকে বেছে নিলেন। চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম এবং পণ্ডিতরা মুইজ্জুর সফরকে মালদ্বীপের বৈদেশিক নীতির একটি 'নতুন এবং ভারসাম্যপূর্ণ' সূচনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সাংহাই ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (এসআইআইএস)-এর গবেষক এবং দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক তথা অধ্যাপক লিউ জংই এই সফরকে চিনের জন্য একটি স্পষ্ট সংকেত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করতে চান। চিনের বিশেষজ্ঞরাও মুইজ্জুর চিন সফর নিয়ে ভারতের 'অযথা উদ্বেগ' এবং 'অস্বস্তি' তুলে ধরেছেন। চিনের বিশেষজ্ঞদের মতে, উপমহাদেশে ভারতের 'আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী'র নীতির মধ্যে ভারত বরাবরই একটি যোগসূত্র আঁকতে চেষ্টা করে। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বেজিংয়ের 'ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা'কে নয়াদিল্লি 'সবসময়' সন্দেহের চোখে দেখে বলেই চিনের বিশেষজ্ঞদের মত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং চেংডু ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্সের প্রধান লং জিংচুন এই ব্যাপারে লিখেছেন, 'ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে তার নিজস্ব প্রভাবের ক্ষেত্র হিসেবে দেখে। দাবি করে যে, মালদ্বীপ-সহ এই অঞ্চলের দেশগুলো তাদের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতকেই অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, মালদ্বীপ বেজিংয়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন- পাইলটের ওপর হামলা যাত্রীর, নেওয়া হচ্ছে কড়া ব্যবস্থা, কোন পদ্ধতিতে কারা দেবেন শাস্তি?