Advertisment

মিতালি রাজ: লং লিভ দ্য কুইন, কিন্তু...

মিতালির নম্বর বিশ্ব ক্রিকেটে যারপরনাই ঈর্ষণীয়। কিন্তু টি-২০ ফর্ম্যাট বড় বড় ব্যাটকেও ধরাশায়ী করে দিতে সক্ষম। ব্যাকরণ মেনে খেলা ক্রিকেট এখানে পাত্তা পায় না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Mithali Raj and her t 20 future

ছবি- টুইটার

মিতালি রাজ নামটার সঙ্গে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ভারতে মহিলা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় মিতালির অবদান অনস্বীকার্য। ক্রিকেটের সব ফর্ম্যাটেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনি। সম্প্রতি টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেট থেকে তাঁর অবসর নিয়ে অনেকরকম চর্চা শুরু হয়েছে। কানাঘুষো খবর যে ইংল্যান্ডের সঙ্গে টি-২০ সিরিজ খেলেই এই ফর্ম্যাট থেকে অবসর নেবেন তিনি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ঘরের মাঠে ওয়ান ডে ও টি-২০ সিরিজ খেলছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। তিন ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজ ইতিমধ্যেই পকেটস্থ করেছে উইমেন ইন ব্লু। এবার পালা তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজের; ৪ মার্চ, সোমবার থেকে যার আসর বসবে গৌহাটিতে।

Advertisment

গত নভেম্বর মাসে মিতালি ওয়ার্ল্ড টি-২০ চলাকালীন জানিয়েছিলেন সম্ভবত সেটিই তাঁর কেরিয়ারের শেষ টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ পরবর্তী বিতর্ক সম্পর্কে সকলেই ইতিমধ্যে অবগত। প্রথম একাদশে মিতালির নির্বাচন নিয়ে তৎকালীন কোচ রমেশ পাওয়ারের সঙ্গে শুরু হয় মিতালি রাজের দ্বন্দ্ব। ড্রেসিংরুমের গণ্ডি পেরিয়ে বিসিসিআই অবধি গড়ায় জল। মিতালি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন কারণ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গ্রুপ ম্যাচ এবং ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম সেমিফাইনালে মাঠের বাইরে রাখা হয়। উল্টোদিকে পাওয়ারের যুক্তি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতার পরে সেমিফাইনালে আর টিম কম্বিনেশন পরিবর্তনে আগ্রহী ছিল না টিম ম্যানেজমেন্ট। রমেশ পাওয়ারের কোচিং সময়কাল শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। খানিকটা সেই কারণেই এই বিতর্কের আঁচ আর বেশিদূর গড়াতে পারেনি।

Mithali Raj and her t 20 future ছবি- টুইটার

নভেম্বরের বিশকাপের পরে ফেব্রুয়ারি মাসে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি টি-২০ ম্যাচ খেলেছেন মিতালি। তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচ হেরে যাওয়ার পরে শেষ ম্যাচে মিতালি রাজকে নেওয়া হয় প্রথম একাদশে। তাতেও খেলার ফলাফলে কোন তারতম্য ঘটেনি। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-২০ সিরিজ শুরু হবে সোমবার এবং আরও একবার হয়ত এই বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। মিতালি রাজ দলে না থাকলে, তিনি কেন দলে নেই এই প্রশ্ন ঘুরবে প্রতিটি মিডিয়ায়। মিতালি ফ্যানরা আরও একবার মনে করিয়ে দেবেন মিতালি রাজকে দলে না রাখা কত বড় ভুল। মিতালি রাজের মত ‘লিজেন্ড’-এর কখনোই এই ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

সত্যিই তাই। মিতালি রাজ ‘লিজেন্ড’। মিতালি রাজ রিজার্ভ বেঞ্চে বসে আছেন এটা যে কোন ক্রিকেটপ্রেমীর কাছেই অভিপ্রেত নয়। তাহলে এর সমাধান কী? সমাধান একটাই। মিতালির নিজে থেকে সরে যাওয়া, টি-২০ ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নেওয়া। এই অবধি পড়ে মিতালি ফ্যানরা নিশ্চয়ই খুব চটে গেছেন। স্বাভাবিক। কিন্তু একবার আবেগ সরিয়ে রেখে নম্বরে চোখ রাখলে কেমন হয়?

নম্বরের কথা যখন এসেই গেল, তখন আগে দেখা যাক ওয়ান ডে বাদ দিলেও, নম্বরের বিচারে টোয়েন্টি-২০ ফর্ম্যাটেও মিতালি কেন ‘লিজেন্ড’।

Mithali Raj and her t 20 future মিতালি রাজের কেরিয়ার নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়

৮৬ টি টোয়েন্টি-২০ ম্যাচ খেলে এখনো অবধি মিতালির সংগ্রহ ২৩০৭ রান। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে মিতালির রান সর্বোচ্চ এবং পুরো বিশ্বে টি-২০ মহিলা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানের তালিকায় মিতালি আছেন ৬ নম্বরে। এখনো অবধি অবশ্য মিতালি একটিও শতরান করেননি এই ফর্ম্যাটে। মিতালির টি-২০ তে ১৭টি ৫০ আছে এবং তাঁর সর্বোচ্চ রান ৯৭। ২০ টি ম্যাচে নট আউট থেকেছেন মিতালি। এই ২০টির মধ্যে ১৭টি ম্যাচ জিতেছে ভারত। এই ১৭ টি ম্যাচে মিতালির স্ট্রাইক রেট হল ১১০.৩৬। পুরুষ ও মহিলা, সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক টি- ২০ ক্রিকেটে এই মুহূর্তে মিতালি আছেন সপ্তম স্থানে, ভারতীয়দের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে, রোহিত শর্মার ঠিক পরেই। রোহিত ও মিতালির রানের ব্যবধান মাত্র ২৪।

নম্বর কথা বলে। মিতালির নম্বর বিশ্ব ক্রিকেটে যারপরনাই ঈর্ষণীয়। কিন্তু টি-২০ ফর্ম্যাট বড় বড় ব্যাটকেও ধরাশায়ী করে দিতে সক্ষম। ব্যাকরণ মেনে খেলা ক্রিকেট এখানে পাত্তা পায় না। এই ফর্ম্যাটে স্ট্রাইক রেট একটা বড় ভূমিকা পালন করে। মিতালির টোয়েন্টি-২০’র স্ট্রাইক রেট ৯৬.৭৭। আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ রানের তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে কেবলমাত্র মিতালি এবং পাকিস্তানের বিসমাহ মারুফের স্ট্রাইক রেট ১০০ এর নিচে।

আরও পড়ুন, র‌্যাঙ্কিংয়ে উত্তরণ রাহুলের, বললেন বিতর্ক তাঁকে বিনম্র করেছে

মিতালির টি-২০-তে সর্বোচ্চ রান (৯৭) এসেছে টি-২০ ক্রিকেটে একেবারেই দুর্বল দল মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে এবং মালয়েশিয়া সেই ম্যাচে মাত্র ২৭ রানে অল আউট হয়ে গেছিল। কেরিয়ারে মাত্র এই একটি ম্যাচেই মিতালির ট-২০ স্ট্রাইক রেট ১২৫ এর ওপরে গেছে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটে মিতালির স্ট্রাইক রেট ১০৬.৩৯। ভারতীয় দলের অন্যান্য তারকাদের মধ্যে ঐ একই সময়ে স্মৃতি মান্ধানার স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৮৮, হরমনপ্রীত কউরের স্ট্রাইক রেট ১২৫.৩৬, এমনকি জেমিমা রডরিগেজের মাত্র এক বছর খেলেই তাঁর টি-২০ স্ট্রাইক রেট নিয়ে গেছেন প্রায় ১২৯ য়ের কাছাকাছি। আর ঠিক এইখানেই পিছিয়ে পড়ছেন মিতালি। গত কয়েক বছরে মহিলাদের ক্রিকেটের প্রচার বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে প্রতিযোগিতা, আর তাই এই ধরনের একশোর কাছাকাছি স্ট্রাইক রেট দিয়ে কাজ চালানো মুশকিল।

মিগ ল্যানিং (১২০.৩১) বা সুজি বেটসের (১৩৩.৬২) মত মিতালির সমসাময়িক বিদেশী খেলোয়াড়দের স্ট্রাইক রেটও কিন্তু গত এক বছরে অনেকটাই বেশী। আর এখানেই পিছিয়ে পড়ছেন মিতালি।

২০১৭ সালে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল কোন টি-২০ ম্যাচ খেলেনি। তার আগে ২০১৬ সালে শেষ চারটি টি-২০ তে ৭৩*, ৬২, ৩৬ ও ৪৯* করেন মিতালি রাজ। ২০১৮ সালটা শুরু করেছিলেন ঠিক একইভাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পরপর দুটি অর্ধ শতরান করেন তিনি।

বছরের শেষ প্রান্তে এসে টি-২০ বিশ্বকাপে অবশ্য দুটি ৫০ করে ম্যাচগুলির সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতে নেন মিতালি। কিন্তু এই দুটি অর্ধ শতরানের বিপক্ষ ছিল পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ড। পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টে জয় পেয়েছিল শুধুমাত্র আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আয়ারল্যান্ড আবার বিশ্বকাপের একটি ম্যাচেও জয়ের মুখ দেখেনি। অপেক্ষাকৃত দুর্বল দুটি দলের বিরুদ্ধে মিতালি অবদান রাখলেও, দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর কাছে অবকাশ ছিল উইকেটে মানিয়ে নেওয়ার পরে নিজের স্ট্রাইক রেট বাড়িয়ে দলের নেট রানরেট বাড়িয়ে রাখা। যদিও গ্রুপের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের দরুণ ভারতের নেট রান রেটের ওপরে ভরসা করার প্রয়োজন পড়েনি, কিন্তু ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অন্যরকম হতেই পারে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারত মিতালিকে ওপেন করতে পাঠায়নি। হরমনপ্রীতের শতরানে ভর দিয়ে রানের পাহাড় গড়ে ভারত। কিন্তু ইনিংসের শেষের দিকে দ্রুত কিছু উইকেট হারালেও ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট মিতালিকে পাঠায়নি কারণ ইনিংসের প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক খেলতে মিতালি অভ্যস্ত নন।

Mithali Raj and her t 20 future ছবি- টুইটার

মেয়েদের ক্রিকেট আপাতত এক আমূল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে খেলোয়াড়দের ফিটনেস, দ্রুত রান তোলার ক্ষমতা, উন্নত হয়েছে ফিল্ডিং। এই মুহূর্তে বিশেষ করে এই ফর্ম্যাটে সময়ের দাবি হলেন সেই ক্রিকেটাররা যারা ইনিংসের শুরু থেকে স্কোরবোর্ড সচল রাখেন এবং দলের প্রয়োজনে দরকার পড়লে বড় শট মারতে পারেন। ভারতীয় দলে এর সবথেকে বড় উদাহরণ হলেন হরমনপ্রীত কৌর। এখানেই পিছিয়ে পড়ছেন মিতালি রাজ। হয়ত ওপেনিং করলে কিছুটা সুযোগ থাকে সময় নিয়ে ইনিংস গড়ে তোলার। কিন্তু দিনের শেষে টি-২০ ১২০ বলের খেলা। এখানে একটি বল নষ্ট করাও ম্যাচ হাতের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। এই ফর্ম্যাটে ইনিংস গড়ে তোলার সময়টুকুও তাই গড়ে দিতে পারে বড় ফারাক। ডট বল খেলার সুযোগ দেয় না টি-২০ ক্রিকেট। অন্যদিকে মিডল অর্ডারে ন্যূনতম সময়টুকু পাওয়া যায় না নিজেকে তৈরি করার। মেরে খেলাই এই খেলার নিয়ম। সেই নিয়ম মেনে তাই এবার বোধহয় মেনে নিতেই হবে যে মিতালি রাজের সময় ফুরিয়েছে, অন্তত টি-২০ র মঞ্চে।

হয়ত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া সিরিজে আমরা পাব কোন নতুন মিতালিকে। হয়ত মিতালি নিজে ক্রমাগত চেষ্টা করছেন নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার, কারণ তাঁর খামতির কথা জানেন সবথেকে বেশি করে তিনি নিজে। তিনি হয়ত আবারও প্রস্তুত নিজেকে টোয়েন্ট-২০ র উপযুক্ত প্রমাণ করতে। কিন্তু এর কি সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে? মিতালি রাজের কি আর কিছু প্রমাণ করার বাকি আছে? ২০ বছরের লম্বা কেরিয়ারে মিতালি রাজের যা অবদান তা বোধহয় সত্যিই কিছু নম্বর দিয়ে বোঝানো যায় না। কিন্তু ক্রিকেট আবার পরিসংখ্যানের-ই খেলা। তাই তাকে অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। অতএব নিজের জন্য, নিজের ফ্যানদের জন্য এবং সর্বোপরি ভারতীয় ক্রিকেটের প্রয়োজনেই মিতালির উচিত সম্মানের সঙ্গে নিজে থেকে সরে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে জায়গা করে দেওয়া।

cricket Mithali Raj
Advertisment