সোমবার বর্তমানে চাঁদের চারদিকে প্রদক্ষিণরত চন্দ্রযান-২ মহাকাশযান থেকে তোলা চাঁদের ভূপৃষ্ঠের ছবি প্রকাশ করে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন, অর্থাৎ ইসরো। ছবিগুলি ২৩ অগাস্ট চন্দ্রযানের টেরেইন ম্যাপিং ক্যামেরা-২ দিয়ে তোলা হয়, প্রায় ৪,৩৭৫ কিমি উচ্চতা থেকে। মূলত চাঁদের মাটিতে 'ইম্প্যাক্ট ক্রেটার' বা সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হওয়া গহ্বরের ছবি।
এই সমস্ত গহ্বরের অনেকগুলিরই নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নামে - আর্নল্ড সমারফেল্ড (জার্মানি), ড্যানিয়েল কার্কউড (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), জন জ্যাকসন (স্কটল্যান্ড), আর্নস্ট মাখ (অস্ট্রিয়া), সার্গেই করোলেভ (প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া), শিশির কুমার মিত্র (ভারত), জন প্লাসকেট (ক্যানাডা), দিমিত্রি রজদেস্তভেনস্কি (প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া), এবং চার্লস এরমিতে (ফ্রান্স)।
#ISRO
Lunar surface imaged by Terrain Mapping Camera-2(TMC-2) of #Chandrayaan2 on August 23 at an altitude of about 4375 km showing craters such as Jackson, Mach, Korolev and Mitra (In the name of Prof. Sisir Kumar Mitra)For more images please visit https://t.co/ElNS4qIBvh pic.twitter.com/T31bFh102v
— ISRO (@isro) August 26, 2019
এঁদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করবে 'শিশির কুমার মিত্র' নামটি। কে এই শিশির মিত্র? কী তাঁর অবদান, যার ফলে চাঁদের গহ্বরের নামকরণ হয়েছে তাঁর নামে? আপাদমস্তক বঙ্গসন্তান এই পদার্থবিজ্ঞানীর জন্ম ১৮৯০ সালে, হুগলির কোন্নগরে। মা শরৎকুমারী দেবী ছিলেন সেই যুগের মেডিক্যালের ছাত্রী, পরে বিহারের ভাগলপুরে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে ডাক্তারের চাকরি পান। বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ছিলেন শিক্ষক। পরে স্ত্রী এবং চার সন্তান নিয়ে ভাগলপুরে এসে করণিক হিসেবে যোগ দেন সেখানকার পুরসভায়।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়তে পড়তে স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর সান্নিধ্যে আসেন শিশির কুমার। পরবর্তীকালে কলেজে জগদীশচন্দ্রের সহ-গবেষক হিসেবেও কিছুদিন কাটান তিনি। এরপর সাংসারিক অনটনের কারণে চাকরি নেন ভাগলপুরে তাঁরই প্রাক্তন কলেজে। তবে ছাইচাপা আগুনের মতোই ফের একবার জ্বলে উঠলেন তিনি, যখন ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ফের একবার ছবি পাঠাল চন্দ্রযান-২, এবার আরও কাছ থেকে
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ তখন আক্ষরিক অর্থেই চাঁদের হাট - সি ভি রামন, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো কিংবদন্তীদের কর্মস্থল। রামনের তত্ত্বাবধানেই আলোকবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন শিশির কুমার, এবং ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-এসসি ডিগ্রি পান তাঁর 'ইন্টারফিয়ারেন্স অ্যান্ড ডিফ্রাক্শান অব লাইট' শীর্ষক থিসিসের জন্য।
১৯২০ সালে ইউরোপ সফরে গিয়ে বিশ্বের আরও কিছু কিংবদন্তী বিজ্ঞানীর সান্নিধ্য পান শিশির কুমার, যেমন চার্লস ফেবরে, মারি কুরি, প্রমুখ। তখন থেকেই রেডিও-ফিজিক্স বা বেতার-পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজে উৎসাহ পান তিনি, এবং ১৯২৫ সালে তাঁরই উদ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বেতার-পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। এই উপমহাদেশে প্রথম বেতার সম্প্রচারও চালু করেন শিশির কুমার, কলকাতা থেকে তাঁর ‘রেডিও টু-সি-জেড' কেন্দ্রের মাধ্যমে। এছাড়াও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণও পরিবেশন করেন তিনিই। বেতার সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আয়নোস্ফিয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ বায়ুমণ্ডলের এই স্তর বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করতে সক্ষম।
আরও পড়ুন: ফের পৃথিবীর কাছাকাছি আসবে বৃহৎ গ্রহাণু, হুঁশিয়ারি নাসার
পদ্মভূষণ শিশির কুমার মিত্রর নামে অতএব চাঁদে গহ্বর থাকাটা অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু ঠিক কীভাবে হয় এই নামকরণ? জানা যায়, চাঁদের গহ্বরের নামকরণের প্রথম প্রচেষ্টা করা হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। কে বি শিঙ্গারেভা এবং জি এ বুরবা তাঁদের বই 'দ্য লুনার নমেনক্লেচার: দ্য রিভার্স সাইড অফ দ্য মুন, ১৯৬১-১৯৭৩'-এ লিখেছেন সেকথা। সেসময় ব্যবহার করা হতো সমাজে প্রখ্যাতদের নাম - বিজ্ঞানী, দার্শনিক, এমনকি রাজারাজড়াও। আবার একেক সময় চাঁদের এবং পৃথিবীর ভৌগোলিক স্থানের মধ্যে মিল থাকলে পৃথিবীর সেই স্থানের নামেই নামকরণ হতো চাঁদের ভৌগোলিক স্থানেরও।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নামকরণের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলী তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ঘোষণা করে, গহ্বর অথবা গহ্বর-জাতীয় স্থানের নামকরণ হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানী (অ্যাস্ট্রোনমার) বা প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের নামে, এবং তা হতে হবে মরণোত্তর।
চাঁদের অন্যান্য ভৌগোলিক ফিচারের মধ্যে পাহাড়ের নামকরণ হয় পৃথিবীর পর্বতমালার সঙ্গে নাম মিলিয়ে, আবার বিস্তৃত অন্ধকার অঞ্চলের নামকরণ হয় মানুষের মানসিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে!