Advertisment

Explained: মুকুলের ঘরওয়াপসির ঘোরতর কারণগুলি কী?

সহ-সভাপতি করে মুকুল রায়কে কেন্দ্রীয় বিজেপি গুরুত্ব দিলেও, রাজ্য বিজেপি যে তাতে সুর মিলিয়েছিল, তেমনটা কারওরই মনে হয়নি। এরপর নির্বাচনে মুকুলকে লড়তে পাঠানো হল কৃষ্ণনগর উত্তরে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
why mukul roy has returned to TMC

আবারও এক ফ্রেমে মমতা-মুকুল ও অভিষেক।

আকাশ তখন মেঘে ঢাকা, বৃষ্টির প্রাক-মুহূর্ত। বিজেপিতে মুকুল ঝরল, ফুটল তৃণমূলে। তৃণমূল ভবনে মুকুল যখন ঢুকলেন, আগে মমতা। চেয়ারে মুকুল বসলেন, কিন্তু মমতা নিজের চেয়ারটা সরাতে বললেন, সে চেয়ার গদি-আঁটা, সরিয়ে প্লাস্টিকের যে ধরনের চেয়ারে মুকুল বসেছেন, অন্যরাও বসেছেন, তেমনটা চেয়ে নিলেন। রায়বাবুর প্রত্যাবর্তনে যেন কোনও অসাম্যের ছবি না থাকে, এ বার্তাই কি দিলেন তৃণমূল নেত্রী? বললেন, 'ওল্ড ইজ অলওয়েজ গোল্ড'।

Advertisment

আরও পড়ুন- নির্বাচনে মুকুল আমাদের দল বিরোধী কথা বলেনি: মমতা

৬৭ বছরের মুকুল রায়, তৃণমূলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি মমতার সঙ্গে ঘাসফুল পোঁতেন বাংলার মাটিতে, তারপর মমতার প্রধান সেনাপতি হয়ে ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম জমানার ইতি টানেন, তার পরের বারও মমতা যে ক্ষমতা ধরে রাখলেন, তাতেও মুকুলের অবদান। অনেকেই বলেন, মুকুলের চোখ দিয়েই তৃণমূলটাকে দেখতে শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুকুলকে কেউ কেউ বঙ্গেশ্বরের তকমাটিও দিয়েছিল।

আরও পড়ুন- ‘দলে ফিরে মুকুল মানসিক শান্তি পেল’, বললেন মমতা

কে না জানত, তৃণমূলে মমতার পরের স্থানটিতে অবশ্যই মুকুল রায়। তাঁর এতটাই প্রভাব ছিল যে, ২০১২ সালে রেলভাড়া বৃদ্ধি করে মমতার কোপে পড়া দীনেশ ত্রিবেদীকে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে মুকুল রায়কে বসান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। অনেকেই বলতেন, তৃণমূলের আবেগের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর নেতৃত্ব প্রশ্নাতীত, আর মুকুল রায় হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ছিলেন কর্মী-নিয়ন্ত্রণের শক্তি। তিনি রাজ্যের ব্লক স্তরের তৃণমূল সদস্যদের নাম ধরে চিনতেন, ফলে তরতরিয়ে এগিয়ে চলত সংগঠনের চাকা। কিন্তু চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। প্রথমে সারদা, তারপর নারদের গোরোয় পড়েন তৃণমূলের তৎকালীন নাম্বার টু। ক্রমে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মন কষাকষির খবর হতে থাকে। ফলে ২০১৭ সালে দুর্গাপুজোর সময় তৃণমূলে মুকুল বিদায়ের বাজনা বেজে ওঠে। মুকুল বিজেপিতে যোগ দেন সে বছরের ৩ নভেম্বর।

বিজেপিতে কি গুরুত্ব পেয়েছিলেন মুকুল?

সে সময় বঙ্গের মসনদ জিততে কোমর বাঁধছে বিজেপি । কিন্তু তাদের সংগঠন অতি-দুর্বল। ফলে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয় সাংগঠন পোক্ত করতে, এবং পরিধি বাড়তে মুকুলকে ব্যবহার করলেন। মুকুলের বহু অনুগামী তৃণমূল ছেড়ে এসে বিজেপিকে বহরে বাড়িয়ে তুলল। এর পর ২০১৯-এর লোকসভা ভোট, বিজেপির অভাবনীয় সাফল্য, ১৮টি আসন জয়। কিন্তু মুকুল কী পুরস্কার পেলেন? শোনা যায়, মুকুল চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হতে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী তাতে আমল দেননি। হয়তো মুকুল দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বলেই, হয়তো…। মুকুল যেন অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকেন বিজেপিতে। বিজেপি ছাড়ব ছাড়ব করতেও থাকেন। এরপর ২০২০-র ২৬ সেপ্টেম্বর মুকুলকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করে বিধানসভা ভোটের আগে রায়মহাশয়ের ক্ষোভপ্রশমন-চেষ্টা। তাঁকে দলে ধরে রাখতে টেক্কা বিজেপির। তাতে তারা সফলও। কিন্তু রাহুল সিনহার মতো পোড়-খাওয়া বিজেপি নেতা মুকুলের এই উত্থানে চরম অখুশি হলেন। কারণ এক কালে রাজ্য বিজেপির এই সভাপতির হাতে তখন পেনসিল। মুকুলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল থেকে আসা আর এক নেতা অনুপম হাজরাকে কেন্দ্রীয় সম্পাদক করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব, রাহুলকে সরিয়ে। রাহুল কী বলেন সে দিন, 'আমি ৪০ বছর বিজেপির সেবা করেছি, জন্মলগ্ন থেকে বিজেপির সেবা করার পুরস্কার এটাই যে তৃণমূল থেকে আসা নেতার জন্য আমাকে সরতে হল। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?'

এর পর মোহভঙ্গের ভরা কোটাল

সহ-সভাপতি করে মুকুল রায়কে কেন্দ্রীয় বিজেপি গুরুত্ব দিলেও, রাজ্য বিজেপি যে তাতে সুর মিলিয়েছিল, তেমনটা কারওরই মনে হয়নি। এরপর নির্বাচনে মুকুলকে লড়তে পাঠানো হল কৃষ্ণনগর উত্তরে। মুকুল নাকি ভোটে লড়তেই চাননি, ফলে বিজেপি নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্তে বেজায় ক্ষুব্ধ হলেন। এবং ভোট-যুদ্ধেও মুকুলকে তেমন আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা যায়নি। এমনকী প্রত্যাবর্তনপর্বে মমতাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন: 'মুকুল কিন্তু প্রচারে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি‌।' মুকুলকে প্রচার অভিযানে ব্যাক-সিটেই দেখা গিয়েছে বলতে হবে। মাঠ কাঁপিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষরা। এবং প্রচারের শেষপর্বে মমতাও বলেছিলেন, 'শুভেন্দুর চেয়ে মুকুল ভাল'। যা নিয়ে চর্চার বান ডাকে। মুকুলের তৃণমূলে ফেরার সলতেটা পাকানোও শুরু হয় হয়তো সেই দিন থেকেই।

কফিনে কী ভাবে শেষ পেরেক?

নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো শুভেন্দু অধিকারীকে বিরোধী দলনেতা করেছে বিজেপি। অনেকেই মনে করছেন, বিজেপির এই সিদ্ধান্তই তৃণমূলের দিকে পুরোপুরি ঠেলে দিয়েছে রায়মশায়কে। তৃণমূলের অনেকের মত, তাঁদের দলে মতোপার্থক্য থাকলেও, মুকুলের মূল্য তাঁরা বুঝতেন। বিজেপিতে তেমনটা মোটেই হচ্ছিল না। শুভেন্দুই আলো কেড়ে নিয়েছিলেন পুরো। পাশাপাশি, গেরুয়া শিবিরের একাংশের এমনও দাবি, একটি ব্যক্তিগত ইস্যুকে তুলে তৃণমূলের তরফে শুভ্রাংশুকে নিয়ে মানসিক চাপ দেওয়া হচ্ছিল মুকুলের উপর, তাই এই বিজেপি-ত্যাগ। আবার অনেকেরই মত, বিজেপিত্যাগের পিছনে মুকুলের স্ত্রী কৃষ্ণার কোভিড সংক্রমণও একটি ইস্যু। অভিষেক কৃষ্ণাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপির তরফে নাকি তেমন ভাবে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পাশেই দাঁড়ানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুকুলকে ফোন করে তাঁর স্ত্রীর খোঁজখবর নিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করলেও, তাতে যে কাজ হয়নি, সেটা স্পষ্টই।

এখন মুকুলের কী ভবিষ্যৎ তৃণমূলে?

মুকুল এক সময়ে তৃণমূলের যে পদে ছিলেন, সদ্য সেই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনে অভিষেককে অস্ত্র করে মমতাকে চরম আক্রমণ শানিয়েছিল বিজেপি, কিন্তু সেই আক্রমণ মাঠে মারা যাওয়ায় এই পুরস্কার পেয়েছেন অভিষেক। অভিষেকের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণটা তাহলে কী হবে মুকুলের, সেই জল্পনাও শুরু হয়েছে। যদিও প্রত্যাবর্তনে মুকুলকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই উত্তরীয় পরিয়েছেন। অভিষেকের সঙ্গে মুকুলের কোনও মতান্তর-মনান্তর নেই বলে স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছেন মমতা। মুকুল সেই কথার সূত্র ধরেছেন। কিন্তু কোন পদে মুকুলকে বসানো হবে তার কোনও মীমাংসা করেননি তৃণমূল নেত্রী। অনেকেই বলছেন, মুকুল বিধায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন, সেই যায়গায় যাবেন ছেলে শুভ্রাংশু, মুকুলকে ফের রাজ্যসভায় পাঠাবেন মমতা। তবে, সেই সঙ্গে নজর থাকবে মুকুলকে অনুসরণ করে কারা এখন তৃণমূলে যোগ দেন, সেদিকে। অনুপম হাজরা এদিনই বঙ্গ বিজেপিতে লবিবাজি চলছে বলে ফেসবুকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। বাংলা বিজেপি কি তাহলে এখন মুষলপর্বে? বাংলা বাজারের আনাচে কানাচে সেই প্রশ্নটার বেড়ে উঠছে বিদ্যুদ্বেগে।

Read in English

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

tmc bjp Mamata Banerjee mukul roy abhishek banerjee
Advertisment