বেঙ্গাই জোত প্রাইমারি স্কুলের ঠিক পাশে সাতটি আবক্ষ মূর্তি, লেনিন, স্তালিন, লিন পিয়াও, চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত এবং মহাদেব মুখার্জির। এই আবক্ষমূর্তি গুলির পাশে একটি লাল বেদিতে ২ শিশু সহ ১১ জনের নাম লেখা রয়েছে, যারা ১৯৬৭ সালের ২৫ মে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল। সেদিন থেকেই নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের শুরু যা স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল হয়ে উঠবে এবং দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।
সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে সেবডেলা জোতে একটি মাটির বাড়ি নতুন করে বানানো হয়েছে, তাতে বাঁশের বেড়া দেওয়া। এ বাড়িতে এক সময়ে থাকতেন প্রয়াত কানু সান্যাল, সিপিআই(এম-এল)-এর প্রতিষ্ঠাতা। সে সংগঠনটিই আজকের সিপিআই (মাওবাদী)-র উৎস সংগঠন।
আরও পড়ুন, নকশাল নেতা চারু মজুমদারের মূর্তি ঢাকল কালো কাপড়ে
এখানে, এই নকশালবাড়িতে, যেখানে নকশাল আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেখানে এখন রাজনৈতিক কথোপকথনের কেন্দ্রে থাকে শক্তিশালী তৃণমূল কংগ্রেসের সামনে কীভাবে মাথা তুলছে বিজেপি। অন্যদিকে কংগ্রেস ও সিপিএম যারা গতবার জোটের জন্য নকশালবাড়ি বিধানসভায় জিতে গিয়েছিল, তারা এবারের লোকসভা ভোটে কোনও বোঝাপড়ায় পৌঁছতে না পেরে চতুর্মুখী লড়াইয়ের মধ্যে পড়েছে।
নকশালবাড়ি দার্জিলিং লোকসবা কেন্দ্রের অন্তর্গত, এ কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের অমর সিং রাইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন বিজেপির রাজু সিং বিস্ত। এস এস আলুওয়ালিয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন শংকর মালাকার, যিনি নকশালবাড়ি-মাটিগাড়ার বিধায়কও বটে। সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন সমন পাঠক।
বেঙ্গাই জোত প্রাইমারি স্কুলের নৃপেন বর্মণ বলছিলেন, "কানু সান্যালের নেতৃত্বে কৃষকরা যখন জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, তখন আমরা ছোট। এখন স্কুলের পর বাচ্চারা যাতে বেদীর উপর চড়ে না নষ্ট করে ফেলে, সেদিকে নজর রাখতে হয়। প্রতি বছর ২৫ মে, কলকাতা থেকে কিছু লোকজন এসে এখানে পতাকা তোলেন। বাকি দিনগুলোতে কেউ আসে না।"
আরও পড়ুন, General Election 2019: ভোটে কী করবে বাংলার নকশালরা?
বেঙ্গাই জোত থেকে আধ কিলোমিটার দূরে নকশালবাড়ি সারদা বিদ্যামন্দির। আর এস এস পরিচালিত সারদা শিশু মন্দির এই স্কুলটি চালানোর দায়িত্বে। এটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় স্কুল। ৬ বিঘা জমির ওপর তৈরি এ স্কুলে নৈতিক শিক্ষা এবং জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ শেখানো হয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালে তৈরি এ স্কুলের ছাত্র সংখ্যা এখন ৬৫৩।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুজিত দাস বললেন, "আমাদের লক্ষ্য হল ভারতীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে শিক্ষাদান। আমাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগাযোগ নেই।"
৪ এপ্রিল তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নকশালবাড়িকেই জনসভা করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন, সে সভায় লোকও হয়েছিল প্রচুর।
নকশালবাড়ির বাসিন্দা তৃণমূল কংগ্রেস জেলা সহ সভাপতি অমর সিনহা বললেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই নকশালবাড়ি কিছু উন্নয়নের মুখ দেখেছে। বিজেপি-আরএসএস যে নকশালবাড়িতে তাদের ভিত্তি বাড়াতে চাইছে সে ব্যাপারে আমরা জানি। ওদের স্কুলও চলছে। কিন্তু ওরা সফল হবে না।"
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী শংকর মালাকার মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি কেন্দ্র থেকে ভোটে জেতেন ১৬ ৮২৭ ভোটে, ভোট পান ৮৬৪৪১টি।
স্থানীয় সিপিএম নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না হওয়ায় ক্ষুণ্ণ, যার ফলে তাঁদের চতুর্মুখী লড়াইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে।
নকশালবাড়ি বাজারের চায়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল চায়-কামান মজদুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গৌতম ঘোষের সঙ্গে। "আরএসএস-বিজেপি এখানে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচারের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের কৌশল নিয়েছে। বামেরা এখানে এখনও প্রাসঙ্গিক এবং পঞ্চায়েতে আমরা ভাল ফল করেছি। বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস আমাদের ভোটে জিতেছিল। এবার আসন ভাগাভাগি না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এখানে চা শ্রমিক এবং কৃষকদের জন্যে লড়াই করে চলেছি।"
দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী শংকর মালাকার বলছিলেন, "জেতার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় পক্ষকে নিয়েই মানুষ ক্লান্ত এবং আমাদের দল পরের বার কেন্দ্রে সরকার গড়তে চলেছে। তবে এখানে বামেদের সঙ্গে আসন সমঝোতা হলে ভাল হত।"
নকশালবাড়ি টাউন ক্লাবের কাছে বিজেপি দফতরে দলীয় পতাকা টাঙানো নিয়ে কর্মীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছে।
বিজেপি ব্লক সভাপতি দিলীপ বারইয়ের কথায়, "আমাদের দলের পতাকার চাহিদা খুব। এই লটটা যাবে চা বাগান এলাকায়। এই প্রথম আমরা চা বাগানে বুথ কমিটি তৈরি করতে পেরেছি। নিঃশব্দে হাওয়া আমাদের দিকে বইছে, বিশেষ করে পাকিস্তানে বিমান হামলার পর থেকে। নরেন্দ্র মোদী জনসভায় কী বলেছেন তা শুনতে এখান থেকে অনেকেই শিলিগুড়ি গিয়েছিলেন।"
নকশালবাড়ি থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে কানু সান্যালের মাটির বাড়ি পর্যটকদের দেখান ২৪ বছরের সুতম মুণ্ডা। ঘরের ভিতরটা খালি, শুধু কানু সান্যালের একটা ফোটো রয়েছে, যে ফোটোয় রয়েছেন সিপিআই এম এলের অন্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরাও।
"আমি ঘরটা সাফ সুতরো রাখি। কলকাতা থেকে এবার ভোটের সময়ে বেশ কয়েকজন এসেছিলেন। ওঁরা আমাদের নোটায় ভোট দিতে বলে গেছেন। আমি এখনও বিষয়টা নিয়ে ভাবছি।"
Read the Story in English