/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/02/queen-elizabeth-ii-1200.jpg)
আকাশে তারার ভিড়, আকাশে রুপার রেখা, বাঁকা চাঁদ জ্বলে;/ রজনী গভীর হয়; বাতাসে মদির গন্ধ; চাঁদ পড়ে ঢলে—’ জানি না, বৃহস্পতিবার মধ্য রাত্রে মধ্য লন্ডনে জমে ওঠা মানুষের ভিড় এই কথা ভাবছিল কিনা। তবে মদিরতার হাতছানির দিকে তাঁরা এগচ্ছিলেন।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে বসার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উপলক্ষে তাঁদের সে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে এসে জোটা। কে বলে শুধু বাঙালি হুজুগে, আমাদের প্রাক্তন শাসকের বংশধররা মোটেই কম কিছু নন। বোঝাচ্ছিলেন তাঁরা পদে পদে। না হলে রানি, যাঁর প্রত্যক্ষ কোনও ছাপই তো নেই রাজনীতিতে, যেন এক বিগত সময়ের ছায়া হয়ে আছেন, তাঁর জন্য কেন এত উদ্বেলতা। হ্যাঁ, সমীক্ষাও বলছে, রানির নাকি দারুণ জনসমর্থন। এবং তা বাড়ছে।
চার দিনের উদযাপনের পর্বটি শুরু ২ জুন, বৃহস্পতিবার। ট্রুপিং দ্য কালার, অনুষ্ঠানে। যেটি ২৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের সরকারি জন্মদিন উপলক্ষে বার্ষিক সামরিক কুচকাওয়াজ। মার্চপাস্ট দেখার জন্য বাকিংহাম প্যালেসের ব্যালকনিতে রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন ৯৬ বছরের রানি। চোখে তাঁর রোদচশমা। যদিও চোখ দৃশ্যমান। সারা মুখ থেকে চুঁইয়ে নামছে পরিতৃপ্তি। আর মদিরা-দৃশ্যটা আষ্টেপৃষ্ঠে উপভোগ করেছিলেন হাজার হাজার দর্শক। আহা, চোখ তো সার্থক!
এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি। রানি এলিজাবেথের পুরো নাম। ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল জন্ম। রাজা পঞ্চম জর্জের শাসন তখন, যিনি মেরির ঠাকুরদা। রাজা পঞ্চম জর্জের ছোট ছেলে ডিউক অফ ইয়র্ক রাজকুমার অ্যালবার্টের বড় মেয়ে এলিজাবেথ। কেউ ভাবতে পারেননি তিনি কুইন হবেন। কিন্তু ভাবনা আর বাস্তব দুটি আলাদা রাস্তায় চলে। আমরা সেই বাস্তবের চমকপ্রদ পথেই হাঁটব এবার। ইতিহাসের পথে।
১৯৩৬ সালের জানুয়ারিতে রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যু হল। তাঁর বড় ছেলে, মানে এলিজাবেথের জ্যাঠা অষ্টম এডওয়ার্ড রাজসিংহাসনে বসলেন। কিন্তু বেশি দিন মুকুট তাঁর মাথায় রইল না। ডাকসাইটে সুন্দরী এবং সমাজের উপরিতলে অবাধ, বিবাহ বিচ্ছিন্না ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করলেন।
রাজা বলে কথা, এমন বেতমিজ বিয়ে তো মেনে নেওয়া যায় না মোটেই, হয় না, রাজ-অভিধান বহির্ভূত এ সব, সুতরাং রাজদণ্ড ছাড়তে হবে, ছাড়তে হল। এর ফলে এলিজাবেথের বাবা রাজা হলেন, আর রাজকুমারী এলিজাবেথ হয়ে গেলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী।
১৯৫১ সাল। রাজার স্বাস্থ্যের অবনতি। মেয়ে এলিজাবেথ তখন বাবার হয়ে প্রক্সি-পারঙ্গম হয়ে উঠলেন। এক ছায়া শাসকের চেহারাটা যেন ফুটে উঠছিল তাঁর ভিতরে। যেন বলছিলেন, আসছি আমি, রোসো…। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি। এলিজাবেথ এবং তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফরে গেলেন। ফেব্রুয়ারিতে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর খবর তাঁদের হৃদয় বিদীর্ণ করল। এর পর, এলিজাবেথ। তিনিই তো। বয়স মাত্র ২৫।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক হল ১৯৫৩ সালের ২ জুন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এলিজাবেথ স্বয়ং। যেমনটা আগে কখনও হয়নি। শুরুতেই প্রথা ভাঙলেন। ২০ মিলিয়ন মানুষ এই অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন জানা যায়। যা সেই সময়ের রেডিও অডিয়েন্সের চেয়েও বেশি।
ক্ষয়িষ্ণু ব্রিটিশ শাসন
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থানপর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে রানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালকে। ১৫৮৩ থেকে ১৬০৩ সাল। কিন্তু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে যখন বসলেন, তখন সাম্রাজ্যের ক্ষয়টা ভরপুর শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯৫২ সালে এলিজাবেথ রানি হওয়ার বেলায়, ব্রিটেনের শাসন ছিল সারা পৃথিবীর ৭০টি অঞ্চলে। যা প্রায় সবটাই ব্রিটেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবে আগামী কয়েকটি দশকে। ভারত, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'মুকুটের রত্ন' ততদিনে ব্রিটেনকে অর্ধচন্দ্র দেখিয়েছে।বিদ্রোহ-আলোচনায় সলতে পাকানোটা অনেক থেকে শুরু হলেও, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট সরকারি ভাবে তাদের বিদায় ঘটেছে।
এর পর, ১৯৫২ সালে মিশর বিদ্রোহ, কেনিয়ার মৌউ মৌউ বিদ্রোহ। দুই দেশের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ব্রিটিশ উপনিবেশে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৭০০ মিলিয়ন থেকে কমে পৌঁছায় ৫ মিলিয়নে। তবে কমনওয়েলথের বাড়বাড়ন্ত হল এলিজাবেথের সময়ে। যখন রানি হলেন, তখন কমনওয়েলথের ৪ সদস্য। কিন্তু তাঁর জামানায় তা বাড়তে বাড়তে এখন ৫৪-তে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার যা এক তৃতীয়াংশ। যদিও কমনওয়েলথের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। অনেকে এর তীব্র বিরোধীও। এই দীর্ঘ সময়ে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সারা পৃথিবীতে ঘুরেও বেরিয়েছেন। শত শত সরকারি সফর। তিনিই সবচেয়ে বেশি সফরকারী রাষ্ট্রপ্রধান।
আরও পড়ুন- কলকাতায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, সিংহাসনের ৭০ বছরে স্মৃতিমেদুর তিলোত্তমা
প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক
রানি এলিজাবেথ নিজেকে পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। বা, বলা যেতে পারে, মানিয়ে নিতে নিতে এগিয়ে গিয়েছেন। ব্রিটেনে রানির কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। রাজতন্ত্র সেখানে প্রতীকী। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এ পর্যন্ত ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি সিংহাসনে বসার সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেলেন উইনস্টন চার্চিলকে।
সারা পৃথিবী যে চার্চিলেন নামে কাঁপত বলা যায়। তাঁর সঙ্গে রানির অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৬৫ সালে চার্চিলের অত্যেষ্টিতে প্রোটোকল ভেঙে হাজির হয়েছিলেন রানি। ১১ বছর ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। তিনিই সে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে রানির সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না শোনা যায়।
ব্রিটেনের রানির বয়স ৯৬ হতে পারে, কিন্তু জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। YouGuv পোল অনুযায়ী ৭৫ শতাংশই রানির পক্ষে। যদিও উত্তরোত্তর রাজতন্ত্রের দিকে থাকা মানুষের সংখ্যা তলানিতে। আর সিংহাসনের উত্তরসূরি রানির বড় ছেলে প্রিন্স চার্লসের পক্ষে সমর্থনের পারদ নেমেছে। মাত্র ৫৪ শতাংশ তাঁর দিকে। প্রিন্স অফ ওয়েলস চার্লসের বয়স এখন ৭৩।
রানি এলিজাবেথ মানেই এক দীর্ঘ সময়সরণি। ব্রিটিশমুক্তির স্বাধীনতা আর বিদ্রোহের দর্শক তিনি। স্বাধীনতার সামনে তিনি বাধ্যত নতজানু। বার বার।
Read full story in English