কেন্দ্রীয় সরকার বুধবার মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করেছে। ছেলেদের বিয়ের বয়স এখন ২১। অর্থাৎ আইনি ভাবে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স এখন সমান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেওয়া এই সিদ্ধান্ত সংস্কারে পথে একটি বড় পদক্ষেপ, কোনও সন্দেহ নেই তাতে। তবে সমালোচনাও হচ্ছে এর। অনেকেরই মত, এতে কাজের কাজটি কিছুই হবে না। কারণ ১৮ বছরের আইনই মানতে চান না অনেকে। অনেকে তো এর অস্তিত্বই স্বীকার করেন না! ২১-এ কি সেই অংশের মন বদলে যাবে?
কেন এই পথে কেন্দ্র?
শৈশবেই বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা, বিশেষ করে মেয়েদের, এই সে দিনও চালু ও প্রতিষ্ঠিত ছিল এই সমাজের মূল স্রোতে। এখন খানিক কমলেও, পুরোপুরি উঠে যায়নি। সাবালকত্বের পর বিবাহ বৈজ্ঞানিক, এটা বহু মানুষের মাথায় গজাল মেরেও এখনও গোঁজানো যায়নি। ১৮ বছর না হলে মেয়েদের বিয়ে মানা, এই আইন করেও তা সম্ভব হয়নি। হ্যাঁ, আইন পুরোটা বিফল তা নয়, পরিসংখ্যানই বলছে কাজ কিছু হয়েছে, এবং বিয়ের বয়স বাড়িয়ে সেই কিছু-র পথে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে চাওয়াটা বৈজ্ঞানিক। বলা হচ্ছে এমনই। এখানে পরিসংখ্যানটা একটু আউড়ে নেওয়া যাক। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে থেকে জানা যাচ্ছে, বাল্য বিবাহের হার কমছে। ২০১৫ সালে যা ছিল ২৭ শতাংশ, ২০১৯-২০-তে হয়েছে ২৩ শতাংশ। কিন্তু কেন্দ্র চাইছে এই হার আরও অনেকটাই কমে যাক। তবে না চাওয়াটাই তো ঘোর অস্বাভাবিক।
এখানে বলে নিতে হবে যে, ১৯৫৫ সালের হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট বা হিন্দু বিবাহ আইনে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। যদিও মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবে সেই বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছলেই কোনও মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়, এটাই তাদের সমাজে স্বীকৃত প্রথা। আর আছে ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট বা বিশেষ বিবাহ আইন এবং ২০০৬-এর বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ আইন। দুটিতেই মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের তা ২১। আপাতত, কেন্দ্রীয় সরকারকে তাদের এই সিদ্ধান্তটিকে আইনের রূপ দিতে হবে। ধাপে ধাপে, যে ভাবে হয়ে থাকে।
নয়া সিদ্ধান্তের বিস্তারিত
নরেন্দ্র মোদী সরকার বেশ কয়েকটি কারণে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স বাড়িয়েছে। তার মধ্যে একটি এবং সবচেয়ে বড় কারণ-- বিয়ের ভুবনে লিঙ্গ-সাম্য তৈরি করা। মানে, ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ের বয়সের ফারাকটাকে ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের দু'জনকে সমাসনে বসানো। বদলে যাওয়া সময়ে এটা প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করেন অনেকে। শারীরিক ভাবে মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত আগে হয়ে ওঠে, এই ধারণাতে বন্দি না থেকে, তাদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিকটাও বিচার করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। বিয়ের বয়স বাড়িয়ে সেই কাজটা করার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। এমনই বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তা ছাড়া, তাড়াতাড়ি বিয়ে হলে, স্বাভাবিক ভাবেই সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাড়াতাড়ি। সেটা অনেক সময় বাচ্চা এবং মা দুইয়ের স্বাস্থ্যকে ঠেলে নিয়ে যায় খাদের কিনারায়। জন্ম দিতে গিয়েও মেয়েটি কিংবা বাচ্চার মৃত্যু হরহামেশাই ঘটে যায়। ফলে এই মৃত্যুতে বিয়ের বাড়তি বয়স লাগাম পারাতে পারে, অন্তত কিছুটা হলেও, মনে করা হচ্ছে এমনও।
জয়া জেটলি কমিটি কী ?
২০২০ সালে মহিলা এবং শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক মেয়েদের বিয়ের বয়স বিবেচনা করার লক্ষ্যে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে। পুষ্টি, রক্তাল্পতা, শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে বিয়ের বয়সের সম্পর্ক খতিয়ে দেখার গুরুদায়িত্ব ওই টাস্ক ফোর্সের কাঁধে দেওয়া হয়। কমিটির মাথায় ছিলেন সমতা পার্টির প্রাক্তন সভাপতি জয়া জেটলি। এছাড়াও ছিলেন নীতি আয়োগের সদস্য (স্বাস্থ্য) ভি কে পাল এবং বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবরা।
কমিটির সুপারিশ কী ছিল?
কমিটি বলে, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হোক। তারা সারা দেশের ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মতামত নিয়েছিল। ১৫টি এনজিও-র মাধ্যমে প্রান্তিক এবং পিছয়ে-পড়া জাতি-জনজাতির তরুণ অংশের ভাবনাচিন্তাও জেনেছিল। গ্রাম-শহর, ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে কমিটি এগিয়ে ছিল বিয়ের বয়স নিয়ে নিয়ে সমাজ কী ভাবছে, তা বুঝে নিতে। কমিটি সরকারকে এও বলেছে, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার যাতে আরও বাড়ে, সেই দিকে নজর দিতে। গহিন এলাকা থেকে স্কুলে পৌঁছানো অনেক সময়ই সমস্যাসঙ্কুল হয়ে ওঠে, ফলে যোগাযোগের উন্নতি প্রয়োজন বলেও তারা সুপারিশ করেছে। স্কুলগুলিতে জীবিকা-উপোযোগী ও ব্যবসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলেছে। যৌনতা সংক্রান্ত শিক্ষার গুরুত্ব তারা মনে করিয়ে দিয়েছে সরকারকে। এবং জয়া কমিটির সওয়াল, এগুলি আগে করা দরকার, না হলে আইন করে কাজের কাজটা বিশেষ হবে না।
তারা জোর দিয়েছে গণ সচেতনতায়। সুপারিশ-- হোক লাগাতার প্রচার। কম বয়সে বিয়ে হলে কী কী সমস্যা সে সংক্রান্ত নানা কিছু তুলে ধরা হোক তাতে। আইন বাস্তবের মাটিতে তা হলে সহজেই চলে আসবে। জোর করে লাভ হবে না।
আরও পড়ুন দশমের ইংরাজি প্রশ্নে ধরণী দ্বিধা হও, অর্ধেক আকাশে শিকল, কী ভাবে?
সমালোচকরা কী বলছেন?
শিশু এবং মহিলা অধিকার রক্ষায় যাঁরা লড়াই করছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই বিয়ের ন্যূনতম বয়স বাড়ানোর পক্ষে নন। তাঁদের মত, এমন আইনের ফলে বেআইনি ভাবে বিয়ের সংখ্যা ভাল মাত্রায় বেড়ে যাবে। তাঁরা বলছেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ হওয়া সত্ত্বেও, এখনও এ দেশে বহু নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে। বয়স বাড়িয়ে তা হলে লাভটা কি! তার চেয়ে নারী শিক্ষার হার, আর্থিক ভাবে আত্মনির্ভরতার হার বাড়ানো জরুরি, এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক আরও বৃদ্ধির প্রয়োজন। আইনে একটা জোরের ব্যাপার থেকেই যায়, এতে পিছিয়ে-পড়া মানুষজনের মধ্যে উল্টো ফল হতে পারে। এমনকি তাদের একাংশের মধ্যে বেড়ে যেতে পারে বিচ্ছিন্নতা বোধ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন