৫২ বছরের নলিনী শ্রীহরণ ভারতের দীর্ঘতম মেয়াদের বন্দিনী। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ভেলোর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার থেকে ৩০ দিনের জন্য প্যারোলে ছাড়া পেলেন। ২৮ বছর আগে, ১৯৯১ সালের জুন মাসে জেলে গিয়েছিলেন নলিনী। তারপর এই প্রথমবার সাধারণ প্যারোলে ছাড়া পেলেন তিনি।
এর আগে অতি সংক্ষিপ্ত, কয়েক ঘণ্টার জন্য তিনি প্যারোলে ছাড়া পান- একবার ভাইয়ের বিয়ের জন্য, আরেকবার বাবার মৃত্যুর পর, ২০১৬ সালে।
মাদ্রাজ হাইকোর্টে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থাপনার জন্য প্যারোলের আবেদন করেছিলেন নলিনী। তাঁর সে আবেদনে সাড়া দিয়েছে আদালত। নলিনীর মেয়ে হরিত্রা পেশায় চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে লন্ডনে থাকেন।
আরও পড়ুন, কেন এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের তারিখ পিছিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট
মা ও পরিবারের সঙ্গে
প্যারোলের সময়ে চেন্নাই শহরে রয়াপেট্টার বাড়িতে থাকবেন না নলিনী। তিনি থাকবেন ভেলোরেই। তাঁর আইনজীবীরা জানিয়েছেন এক মাসের জন্য মা পদ্মাবতীর সঙ্গে থাকবেন বলে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন নলিনী। হরিত্রা জেলে জন্মেছিলেন। মনে করা হচ্ছে তিনি মা এবং ঠাকুমার সঙ্গে এসে থাকবেন।
নলিনীর বোন কল্যাণী এবং তাঁর পরিবারের লোকজন, ভাই ভাগ্যনাথন ও তাঁর পরিবার, এবং কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব সম্ভবত নলিনীর সঙ্গে এক মাসের প্যারোলের সময়ে দেখা করতে আসবেন।
নলিনীর স্বামী শ্রীহরণ ওরফে মুরুগানের পরিবার শ্রীলঙ্কার বাসিন্দা ছিলেন। তিনিও রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডে অপরাধী। হরিত্রার সঙ্গে নলিনীর কাছে সম্ভবত আসবেন তিনিও।
প্যারোলের শর্তাবলী অনুসারে নলিনী কোনও রাজনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না, কোনও বিবৃতি দিতে পারবেন না এবং সংবাদমাধ্যমে কোনও সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না।
তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে এই একমাস সময়ের পুরোটাই মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতিতে ব্যয় করবেন নলিনী। বিয়ের ব্যাপারে নলিনীর কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই বিশদে জানেন না। তাঁরা বলছেন, হরিত্রা সম্ভবত এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন শুধু তাঁর বাবা-মায়ের কাছেই।
আরও পড়ুন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার মামলার আশ্চর্য পরিসংখ্যান
রাজীব হত্যা মামলা
১৯৯১ সালের মে মাসে রাজীব গান্ধীর হত্যা দেশের অন্যতম হাই প্রোফাইল মামলা। বহু রহস্য এবং অপ্রমাণিত ষড়যন্ত্র নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। ১৯৯১ সালের ২১ মে এলটিটিই-র মানববোমা বিস্ফোরণে নিহত হন রাজীব গান্ধী। সেখানে উপস্থিত ছিলেন নলিনী।
নলিনী এবং মুরুগান রাজীব হত্যার পর বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন। ১৯৯১ সালের ১৫ জুন চেন্নাইয়ে সৈদাপেট বাস স্ট্যান্ড থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
তদন্তকারীরা বেশ কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করেন, যা থেকে বোঝা যায় শিবরসন, শুভা এবং ধানুর সঙ্গে নলিনী হত্যাকাণ্ডের আগে বেশ কিছু জায়গায় যান। এর মধ্যে শিবরসন ও শুভা ব্যাঙ্গালোরে একটি অপারেশন চালানোর সময়ে আত্মহত্যা করেন। ধানু ছিলেন আত্মঘাতী মানবোমা। নলিনীকে খুঁজতে বিশাল অপারেশন চালানো হয়।
যদিও নলিনীর ভূমিকা সন্দেহাতীত কিনা তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরা রাজীব হত্যাকারী হওয়ায় তিনি এ মামলার কেন্দ্রে থেকেছেন।
মূল ষড়যন্ত্রীদের কাউকেই জীবিত না ধরা যাওয়ায়, ১৯৯৮ সালে এক টাডা আদালত নলিনীর মা পদ্মাবতী এবং ভাই ভাগ্যনাথনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের মুক্তি দিলেও নলিনী, নুরুগান এবং অন্য পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
আরও পড়ুন, সংকটে পড়লেই কেন কামরাজের কথা মনে পড়ে কংগ্রেসের
সুপ্রিম কোর্টে মামলা
তিন বিচারপতির বেঞ্চের দুজন নলিনীর মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দিলেও বিচারপতি কে টি টমাস প্রমাণ উল্লেখ করে বলেছিলেন, নলিনী কেবলমাত্র বশংবদ হিসেবে কাজ করেছিলেন, কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি।
২০০০ সালে নলিনীকে মৃ্ত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
নয়ের দশকের প্রেক্ষিত
এই সময়ে প্রায় সমস্ত তামিল পরিবারের এলটিটিইর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে এবং শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সমর্থন জানাতে থাকে। টাইগার বা এলটিটিই-র প্রতি সহানুভূতিশীলদের শেলটার দেওয়া বা তাদের আর্থিক সহায়তা করা হয়ে ওঠে গর্বের বিষয়। যোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠে প্রাত্যহিক বিষয়, সে সাধারণ মানুষই হোন বা রাজনীতিবিদ। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তামিল নেতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এলটিটিই-র হাতে লক্ষলক্ষ টাকা তুলে দেন। ভারতীয় সরকারের টাইগারদের সাহায্য করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া একটা সময়ে হয়ে উঠেছিল ওপেন সিক্রেট।
আরও পড়ুন, ভাড়াটিয়া তথ্য যাচাই, না করলে কী কী বিপদে পড়তে পারেন আপনি
১৯৯১ সালে ২৪ বছর বয়স, কে এই নলিনী?
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট নলিনী চেন্নাইয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তাঁর বাবা পি শংকর ছিলেন পুলিশ ইনস্পেক্টর, মা পদ্মাবতী ছিলেন নার্স। পি শংকর মারা যান ২০১৬ সালে। নলিনী ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়।
বাবা-মায়ের মধ্যের বৈবাহিক অশান্তির কারণে ছোটবেলা খুব সুখের ছিল না। নলিনী যখন কিশোরী, সে সময়েই তাঁর বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে ছাত্রী অবস্থাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান নলিনীও। শহরেরই এক আত্মীয়ার সাহায্যে খরচ চালাতে থাকেন তিনি।
এ মামলার অন্য অপরাধীদের মত নলিনী বা তাঁর পরিবারের কোনও রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না। তাঁর ভাই বাগ্যনাথনের কিছু বন্ধুবান্ধবের সুবাদে মুরুগান তাঁদের বাড়িতে আসেন।
অভিযোগে বলা হয়েছিল মুরুগান ভারতে এসেছিলেন হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করতে। তবে নলিনীর আত্মজীবনী সহ একাধিক অন্য মতানুযায়ী, উত্তর শ্রীলঙ্কার যুদ্ধ বিধ্বস্ত কিলিনোচি থেকে বিদেশে পালানোর উদ্দেশ্যে ভিসার জন্য এ দেশে এসেছিলেন মুরুগান।
আরও পড়ুন, এনআইএ সংশোধনী বিল: বদলগুলি কী কী
এবার কী
নলিনী ও মামলায় অপরাধী সাব্যস্ত আরও ৬জন আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের দণ্ড যাতে হ্রাস করা হয়।
তামিলনাড়ু মন্ত্রিসভা গত বছরই সাতজন অপরাধীকেই মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব রাজ্যপালকে দিয়েছে। রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ায় নলিনী মাদ্রাজ হাইকোর্টে আবেদন করেছেন যাতে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত লাগু করার জন্য রাজভবনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আদালত এ আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেছে, রাজ্যপালকে তারা কোনও নির্দেশ দিতে পারে না।
হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবার সুপ্রিম কোর্টে যাবেন নলিনী। সংশোধনমূলক বিচারের প্রসঙ্গ তুলবেন তিনি। একই সঙ্গে মন্ত্রিসভার প্রস্তাব সম্পর্কে রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যর্থতা প্রসঙ্গেও সওয়াল করা হবে।
Read the Story in English