ডিএমকে নেতা উদয়নিধি স্ট্যালিন সনাতন ধর্মকে, 'মশা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং করোনা'-র সঙ্গে তুলনা করেছেন। যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিজেপির বেশ কয়েকজন নেতা। দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা উদয়নিধির বক্তব্যকে 'আমাদের ধর্ম'-এর ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, সনাতন আর হিন্দু ধর্মের মধ্যে কি আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে?
সনাতন ধর্মের শিকড়
সনাতন ধর্ম হল একটি সংস্কৃত পরিভাষা। যাকে 'শাশ্বত ধর্ম' বা 'শাশ্বত আইন', 'অপ্রতিরোধ্য, পূজনীয় আদেশ' বা 'প্রাচীন এবং অব্যাহত নির্দেশিকা'ও বলা যেতে পারে। পৌরাণিক কাহিনিবিদ এবং লেখক দেবদত্ত পট্টনায়েক এক্স-এ বলেছেন, 'সনাতন' শব্দের অর্থ চিরন্তন। বেদের চেয়েও প্রাচীন। সনাতন শব্দটি ভগবদ গীতায় ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এটা আত্মার জ্ঞানকে বোঝায়। এমন জ্ঞান, যা চিরন্তন। বলা যায় যে সনাতন ধর্ম হল শাশ্বত। যা আত্মা এবং পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে।'
বিদেশি লিপনারের দৃষ্টিতে সনাতন
তাঁর বই, 'হিন্দুস: তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অনুশীলন' (১৯৯৪ সালে প্রকাশিত)-এ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দুধর্মের এমিরেটাস এবং ধর্মের তুলনামূলক বিভাগের অধ্যাপক জুলিয়াস জে লিপনার লিখেছেন যে, 'গীতায় 'সনাতন ধর্ম' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্জুন যখন কৃষ্ণকে বলেছিলেন যে, যখন বংশ নষ্ট হয়, তখন সনাতন-ধর্ম ধ্বংস হয়। অনুরূপ একটি শব্দ বস্ত্রহরণ পর্যায়ে দ্রৌপদী ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, উপস্থিত ব্যক্তিরা কেউ তাঁর পক্ষে কথা বলেননি। কিন্তু, এই চিরন্তন ধর্ম ঠিক কী, তা স্পষ্ট নয়।'
বিদেশি জাভোসের দৃষ্টিতে সনাতন
ঐতিহাসিক জন জাভোস তার ২০০১ সালের প্রবন্ধে, 'হিন্দু ঐতিহ্য রক্ষা: ঔপনিবেশিক ভারতে গোঁড়ামির প্রতীক হিসেবে সনাতন ধর্ম' বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর দাবি যে শব্দটি ১৯ শতকের শেষের দিকে বিভিন্ন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উৎপত্তির সঙ্গে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।' একইসঙ্গে অবশ্য জাভোসের দাবি, গোঁড়া হিন্দুদেরকে আগে সনাতনী বলা হত। জাভোস তাঁর প্রবন্ধে ১৮৯১ সালের পঞ্জাব সেন্সাস রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, সেখানে সেন্সাস সুপারিনটেনডেন্ট গোঁড়া হিন্দুদেরকে 'সনাতন ধর্মী' হিসেবে নথিভুক্ত করেছেন।
হিন্দু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত
যদিও এই শব্দটি সাধারণত হিন্দু ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। তবে, সনাতন ধর্ম শব্দটি জৈন এবং বৌদ্ধরাও ব্যবহার করে। কারণ, তারাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। পট্টনায়েক বলেন, 'এই শব্দটি এমন ধর্মের জন্য ব্যবহার করা হয় না, যারা একজীবনে বিশ্বাস করে। খুব সম্প্রতি, বিশেষ করে ১৯ শতকের শেষের দিক থেকে সনাতন ধর্ম আর হিন্দুধর্মকে অভিন্ন হিসেবে বোঝানো শুরু হয়েছে। এটা করা হয়েছে হিন্দুধর্মের মধ্যে একতা বাড়াতে। অনেক হিন্দু নিজেদেরকে সনাতানিস্ট বলেন। অর্থাৎ, যাঁরা শাশ্বত ধর্ম অনুসরণ করেন।'
১৯ শতকে সনাতন ধর্ম
সেই সময়ে সনাতন ধর্মকে গোঁড়ামির প্রতীক বলে অভিযোগ করত ব্রাহ্মসমাজ এবং আর্য সমাজের প্রচারক এবং 'সংস্কারক'রা। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দু ধর্মের উলটো প্রচার করা সময়ের প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, পঞ্জাবে আধুনিক সনাতনবাদী আন্দোলনগুলো পণ্ডিত শ্রদ্ধা রামের কর্মজীবনে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী হিন্দু ধর্মের সংস্কারের চেষ্টায় পঞ্জাব সফর করেছিলেন। তখন শ্রদ্ধা রাম পালটা গোঁড়ামির শক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য দয়ানন্দ সরস্বতীকে অনুসরণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন- Explained: ‘সনাতন ধর্ম’কে ব্যাপক গালমন্দ উদয়নিধির, জন্ম থেকেই ডিএমকে হিন্দু-বিরোধী?
পঞ্জাবে হিন্দু ধর্মকে রক্ষার চেষ্টা
একইভাবে ১৮৯০-এর দশকের পঞ্জাবে পণ্ডিত দীনদয়াল শর্মা আর্য সমাজের শিক্ষার বিরুদ্ধে কিছু ধর্মীয় রীতি যেমন মূর্তি পূজা বা মূর্তি পূজাকে রক্ষা করতে শুরু করেন। তিনি 'সনাতন ধর্মসভা' নামে একটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জাতীয় সংগঠন, 'ভারত ধর্ম মহামণ্ডল', যেটি এই সময়ে তৈরি হয়েছিল, তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, 'সনাতন ধর্ম অনুসারে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার করা।' এরপর হিন্দু মহাসভা তৈরি হয়েছিল আর্য সমাজের মত বিভিন্ন গজিয়ে ওঠা সংগঠনের হাত থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষার উদ্দেশ্যে।