Advertisment

সার্স মহামারীর থেকে শিখেছিল পূর্ব এশিয়া; করোনার থেকে কী শিখবে ভারত?

আলাদা করে বলতে হয় ভিয়েতনামের কথা - ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ মে'র মধ্যে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ২৮৮, যাঁদের মধ্যে 'অ্যাক্টিভ কেস' বলতে স্রেফ ৪৭ জন, মৃতের সংখ্যা শূন্য।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sars covid-19 virus

ছবি: প্রশান্ত নাদকার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আজ থেকে ১৫ বছরেরও বেশি আগে, ২০০৩ সালে যখন পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে সার্স (SARS) মহামারী, তখন ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাডাম ট্রান থি ট্রুং চিয়েন আমায় বলেছিলেন, "মিঃ ইন্দু, আমরা কিন্তু স্রেফ ভাটার সময়েই কাঁকড়া ধরতে পারি।" উপকূল-প্রধান দেশ ভিয়েতনাম, সেখানে উইনস্টন চার্চিলের বিখ্যাত উক্তি সুকৌশলে একটু বদলে নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। উক্তিটি ছিল, "ভালো সঙ্কটের কখনও অপচয় হতে দিও না (Never let a good crisis go to waste)"।

Advertisment

সেসময় আমি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ছিলাম, এবং SARS সঙ্কটে ব্যাঙ্কের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তার পরিকল্পনা এবং তদারকির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেসময় বেশ বড় রকমের জনস্বাস্থ্য সঙ্কট হিসেবেই গণ্য হয় SARS, যদিও বর্তমানের Covid-19 সঙ্কটের প্রভাব বা বিস্তৃতির তুলনায় তার কিছুই ছিল না। SARS-এর দ্বারা ২৯ টি দেশে সংক্রমিত হন আট হাজারের কিছু বেশি মানুষ, মৃত্যু হয় ৭৭৪ জনের। তা সত্ত্বেও পূর্ব এশিয়ার মানুষ এবং বিভিন্ন সরকারের ঘুম ভাঙানোর পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল, এবং সত্যিই সেই সঙ্কটের অপচয় হতে দেন নি তাঁরা।

আরও পড়ুন: টেস্ট বেশি হচ্ছে তামিলনাড়ুতে, হিসেবে অনেক পিছিয়ে বাংলা

SARS মহামারী থেকে নেওয়া শিক্ষার ফল Covid-19 ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্পষ্টই প্রতীয়মান পূর্ব এশিয়ায়। এদের মধ্যেও আলাদা করে বলতে হয় ভিয়েতনামের কথা - ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ মে'র মধ্যে সংক্রমিতের সংখ্যা ২৮৮, যাঁদের মধ্যে 'অ্যাক্টিভ কেস' বলতে স্রেফ ৪৭ জন, মৃতের সংখ্যা শূন্য।

কী শিখিয়েছিল SARS

সার্স-পরবর্তী যুগে দৃশ্যতই বদলে যায় পূর্ব এশীয় দেশগুলির জীবনযাপন। চিন, হংকং, তাইওয়ান, জাপান, এবং কোরিয়ায় প্রকাশ্য স্থানে মুখ ঢেকে রাখাই দাঁড়িয়ে যায় নিয়মে। মহামারীর অবসানের পরেও এই প্রথা চালু থাকে। সর্দি বা কাশি হলে তো মানুষ অফিসেও যান মুখ ঢেকে। প্রকাশ্য স্থানে কোনও কিছুতে হাত দেওয়া নিয়ে গড়ে ওঠে নতুন নিয়মাবলী। পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ মানুষই এখনও লিফটের বোতাম টেপেন আঙুলের গাঁট দিয়ে, সরাসরি আঙুল দিয়ে নয়। গণ শৌচালয়ও ব্যবহার করেন সাবধানে, পরিচ্ছন্নতা বিধি মেনে। নিয়ম করে প্রায়শই হাত ধোন সকলেই।

কর্মজীবন এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয়েও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে SARS মহামারী। সঙ্কট চলাকালীন ভ্রমণের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা থাকার ফলে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক সেই প্রথম চালু করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঋণদান সংক্রান্ত আলোচনা। দেখা যায়, তার কার্যকারিতা মুখোমুখি আলোচনার সমান, এবং তাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। ক্রমশ বোঝা গেল, ব্যবসা সংক্রান্ত সফরের অনেকটাই কাটছাঁট করা সম্ভব।

তবে এগুলির চেয়েও অনেক বড় প্রভাব হলো ওই অঞ্চলের সরকারগুলির উপলব্ধি, যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ কতটা জরুরি। SARS-পূর্ববর্তী যুগে ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে স্বাস্থ্য খাতে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না বিভিন্ন সরকারের, বরং এই ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক অনুদানের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। ব্যাঙ্কের অধিকাংশ ঋণই নির্দিষ্ট হতো পরিকাঠামো প্রকল্পের জন্য। সার্স সঙ্কটের পর বদলে যায় এই মানসিকতা। একাধিক দেশ বুঝতে পারে যে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম খরচ করা হচ্ছে, এবং দ্বিপাক্ষিক দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া অপেক্ষাকৃত কম অনুদানে আর কুলোবে না।

আরও পড়ুন: নর্দমার জল থেকে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার কথা বলছেন গবেষকরা

নিজেদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা উপলব্ধি করে দ্বিমাত্রিক একটি প্রক্রিয়া চালু করল চিন - এক, আরও মজবুত করা হলো সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা, এবং দুই, সামাজিক স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় আনা হলো আরও অনেক বেশি মানুষকে, অনেকটা 'আয়ুষ্মান ভারত'-এর মতো। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনগুণ বেড়ে গেল স্বাস্থ্য খাতে সরকারি খরচ, এবং দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যাই বর্তমানে স্বাস্থ্য বীমার আওতায়।

এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, এমনকি লাওস বা কাম্বোডিয়ার মতো ছোট দেশও, নিজেদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বড় রকমের বিনিয়োগ করে, নিজেদের প্রহরা এবং রিপোর্টিং ক্ষমতা বাড়ায়, এবং উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ায় তাদের স্বাস্থ্য বাজেটও। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের জন্য বড় ঋণের চাহিদাও বেড়ে যায় আনুপাতিক হারে। উদাহরণস্বরূপ, সারা দেশে একটি মজবুত এবং পরস্পর-সংযুক্ত ল্যাবরেটরি ব্যবস্থা গড়ার উদ্দেশ্যে বড়সড় ঋণ নেয় ভিয়েতনাম।

SARS, এবং তৎপরবর্তী H1N1 সঙ্কটের জেরে একরকম বাধ্য হয়েই মহামারী মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ায় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি। অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN) এবং অন্যান্য কিছু আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার নেতৃত্বে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সঙ্কট চিহ্নিত করা, এবং সেগুলি সম্পর্কে তথ্য আদানপ্রদান বিষয়ে কার্যকর করা হয় কিছু প্রক্রিয়া এবং চুক্তি।

আরও পড়ুন: কীভাবে করোনা সঙ্কট চিরদিনের মতো পাল্টে দিতে পারে খেলার দুনিয়া

SARS-এর ফলে আরও যা হয়, তা হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization বা WHO) সমর্থন লাভ করে তাদের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিধি (International Health Regulations বা IHR) সংশোধন করার। এই সংশোধনের ফলে সংস্থা ক্ষমতা অর্জন করে সদস্য দেশগুলির কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার, এবং পড়শি দেশের সঙ্গে মহামারী সংক্রান্ত যে কোনোরকম তথ্যের আদানপ্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৫-এর মধ্যে স্রেফ ১৮ মাসে IHR-এর অনুমোদন করে সমস্ত সদস্য দেশ - আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হিমবাহ-সম গতির তুলনায় যা প্রায় আলোর গতির সমতুল।

এই সমস্ত সংস্কারের ফলে নিশ্চিতভাবে Covid-19 মহামারীর ক্ষেত্রে অনেক কার্যকরী লড়াই লড়তে পেরেছে পূর্ব এশিয়া। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য, পর্যটন, সংস্কৃতি, এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক বয়স্ক নাগরিক থাকা সত্ত্বেও, এই মহামারীর সেরকম প্রভাব পড়ে নি এই অঞ্চলে। ভবিষ্যতের গবেষণা আরও জ্ঞানদান করবে আমাদের, তবে মুখে মুখে শুনে যা মনে হচ্ছে, তাতে এই ব্যাপক হারে স্বাস্থ্যবিধি মানা, এবং মজবুত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, এর জন্য অনেকটাই দায়ী। SARS, H1N1, বা MERS সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যেসব নিয়ম লাগু হয়, সেগুলি আজ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

সঙ্কটে শিক্ষণীয়

ভারতেও নিশ্চয়ই Covid-19 পরবর্তী সময়ে অপরিবর্তনীয় ভাবে বদলে যাবে জীবনযাপন, সামাজিক রীতিনীতি, কর্মক্ষেত্রের নিয়ম, এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কতটা সুদূরপ্রসারী হবে এই বদল, তা সময় বলবে। নিয়মিত হাত ধোয়া বা অন্যান্য পরিচ্ছন্নতা বিধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, আমাদের দিনচর্যার অঙ্গ হয়ে উঠবে কিনা; আমাদের কাজের প্রক্রিয়া বদলাবে কিনা, প্রযুক্তির ওপর বেশি, এবং ভ্রমণের উপর কম, জোর দেব কিনা আমরা; টেলিমেডিসিন-এর মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধা পাবেন কিনা; রোগের ক্ষেত্রে আমাদের পাহারাদারি আরও মজবুত হবে কিনা; এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে আমাদের সমকক্ষ দেশগুলির স্তরে আসে কিনা; এসবই সময় বলবে।

আমার দৃঢ় ধারণা, ভারতও এই সঙ্কটের অপচয় করবে না।

(লেখক Ayushman Bharat-PM-JAY এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment