একুশের বিধানসভা নির্বাচনী রাজনীতিতে 'স্লোগান যুদ্ধই' গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ১৮ আসনে জয় লাভের পর থেকেই বিজেপির 'জয় শ্রী রাম' স্লোগানে মুখর হয়ে বাংলা। যা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান শুনে কখনও গাড়ি থেকে নেমে তেড়ে গিয়েছেন, আবার নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে এই স্লোগানের প্রতিবাদে ভাষণ না দেওয়ার মত প্রতিবাদও করেছেন। তবে পাল্টা দিতে ছাড়েননি। পদ্ম শিবিরকে একহাত নিতে তৃণমূল এনেছে 'জয় বাংলা' স্লোগান।
তৃণমূল সুপ্রিমো থেকে তাঁর দলের নেতারা, সকলের দাবি 'জয় শ্রী রাম' স্লোগানটিও বিজেপির মত 'বহিরাগত'। তবে পিছিয়ে নেই পদ্ম শিবির। 'স্লোগান-যুদ্ধে' রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে একটি ‘বৃহত্তর বাংলাদেশ’ গঠনের চেষ্টা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সাফ জানিয়েছেন এই স্লোগান সম্পূর্ণই 'ইসলামিক বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান'! বিজেপির এই অভিযোগ কি আদৌ সঠিক? না কি তৃণমূলের দাবিই ঠিক ?
হ্যাঁ, একটি বিষয় সঠিক যে, 'জয় বাংলা' এক সময় বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ছিল। বিশেষত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ইতিহাস যদি দেখা যায় তবে ১৯২২ সালে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই সময় এই স্লোগানের উৎপত্তি। তখন অবশ্য বাংলা অবিভক্তই ছিল। পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ বিভাজন তখনও হয়নি। এখন প্রশ্ন হল- 'জয় বাংলা' শব্দদ্বয়ের উৎপত্তির ইতিহাস কি এটাই? ইতিহাস জানাচ্ছে- না।
আরও পড়ুন, ‘বিজেপির স্লোগান আমাদের সাহায্য করবে, কিন্তু ফাঁদে পড়লে হবে না’
১৯২২ সালে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছে জোরকদমে। বাংলায় বিপ্লবীদের চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে, ইংরেজ অত্যাচারের শিকল ভেঙে লড়াই করতে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম লিখলেন 'পূর্ণ অভিনন্দন'। সেই কবিতার পঞ্চম স্তবকে কবি লিখেছেন, "জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ/ জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!"। উপনিবেশবাদ, বিদেশি নিপীড়ন, শোষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে বাংলাকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যেই এই কবিতা নজরুলের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সময় বিপ্লবীদের কাছে অনুপ্রেরণা ছিল এই কবিতাগুলিই। ১৯৭২ সালে 'বাংলাদেশের জাতীয় কবি'র উপাধি দেওয়া হয় নজরুল ইসলামকে।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষার জন্য, ভাষাকে নিজেদের করতে পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে এই লড়াই চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের লড়াই ছিল সেটাই। ১৯৬০ থেকে সেই লড়াইয়ের সূচনা হয়। ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নিজেদের সরকার গঠনের লড়াইয়ে ১১ দফার সনদ ঘোষণাও করে। আর সেই সময় থেকেই তখনকার পূর্ববঙ্গে উচ্চারিত হয় সেই স্লোগান, 'তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ' এবং 'জয় বাংলা'। ১৯৭১ সালে এই স্লোগানটি হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের স্লোগান। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে, সারা পূর্ববঙ্গে তখন একটাই স্লোগান- 'জয় বাংলা'। যে স্লোগানকে হাতিয়ার করেই ফুঁসে উঠেছিল বাংলাদেশের লড়াই। এরপর ৭ মার্চে ঢাকার রমনা পার্কে বাংলাদেশের জনক মুজিবরের সেই উদ্দীপিত ভাষণ- ‘‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। জয় বাংলা।’’ স্বাধীনতার পরও এই 'জয় বাংলা' স্লোগানটিই ছিল বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন দেশের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন খন্দেকর মোস্তাক আহমেদ, সেই সময় 'জয় বাংলা' স্লোগান বদলে জাতীয় স্লোগান করে দেন 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'।
আরও পড়ুন, মমতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ইসলামিক বাংলাদেশের, ফেসবুকে প্রতিবাদ দিলীপের
এরপর সময় নদীর জল গড়িয়েছে অনেক। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ফের 'জয় বাংলা'কে সিলমোহর দিতে বাংলাদেশ হাইকোর্টে মামলা করেন আইনজীবী বশির আহমেদ। তাঁর মত, "জয় বাংলা আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্যের স্লোগান ছিল। সুতরাং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এটি জাতীয় স্লোগান হিসাবে থাকা উচিত।" আদালতের শুনানি চলাকালীন আইনজীবী এও বলেছিলেন যে এই স্লোগান মানুষকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই এটিকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা দেওয়া উচিত। এরপর ২০২০ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশ হাইকোর্ট ‘জয় বাংলা’ কে দেশের জাতীয় স্লোগান হিসাবে ঘোষণা করে।
একুশের নির্বাচনী রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন 'জয় বাংলা' স্লোগান আনলেন সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে অনেকটাই। এই স্লোগান কি কেবল 'পাল্টা'? না কি পশ্চিম বাংলাকে বিজেপি 'মুক্ত' করতে পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের মূল স্লোগানকে হাতিয়ার করতে চাইছেন? সে উত্তর পাওয়া যেতে পারে আগামী দিনে।
Read the story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন