নেপালের সুপ্রিম কোর্ট বুধবার সিরিয়াল কিলার চার্লস শোভরাজকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সিরিয়াল কিলার ১৮ বছর নেপালের জেলে হত্যার সাজা ভোগ করল। এর আগে ফরাসি পর্যটকদের বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ ভারতের জেলে ছিল শোভরাজ।
কেন মুক্তি
নেপালের আদালত শোভরাজকে ১৫ দিনের মধ্যে মুক্তি দিয়ে তার বর্তমান দেশ ফ্রান্সে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। ৭৮ বছর বয়সি শোভরাজ স্বাস্থ্যের কারণে দ্রুত মুক্তির আবেদন করেছিল। তার হার্ট এবং দাঁতের অবস্থা খারাপ। এনিয়ে নেপাল সরকারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিল ফ্রান্স।
কুখ্যাতি
তার দীর্ঘ অপরাধ জীবনে, শোভরাজ 'বিকিনি কিলার' বলে কুখ্যাতি অর্জন করে। কারণ, সে যাদের খুন করেছিল, হত্যার পর দেখা গিয়েছে, সেই মহিলারা বিকিনি পরা। আর, গ্রেফতারিতে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পুলিশের খাতায় শোভরাজ 'সাপ' নামেও কুখ্যাত। দেখে নেওয়া যাক শোভরাজের অপরাধনামা।
জন্মকাহিনি
শোভরাজের জন্ম তৎকালীন ফরাসি-অধিকৃত সাইগনে। তার বাবা একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। আর, মা ভিয়েতনামের দোকানে সহকারির কাজ করতেন। তার মা-বাবা বিবাহিত ছিলেন না। বাবা কখনও পিতৃত্ব স্বীকারই করেননি। শোভরাজ পরে ফ্রান্সে চলে আসে। তার মা একজন ফরাসি সৈনিককে বিয়ে করেন। শোভরাজের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে ছোট থেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল।
পেশাদার খুনি
শোভরাজ যখন বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ শুরু করে, তখন তার টার্গেট হয়ে ওঠে 'হিপ্পি'রা। এশিয়ায় ঘুরতে আসা ইউরোপের পর্যটকরাই ছিল তার টার্গেট। সে তাদের পানীয় খাওয়াত। তারপর খুন করত। শোভরাজের বিরুদ্ধে প্রায় ২০টি খুনের অভিযোগ আছে। যদিও তার উদ্দেশ্য কখনও পরিষ্কার হয়নি। মাঝে মাঝে, সে পাসপোর্ট চুরি করত। যাদেরকে হত্যা করেছে, তাদের পরিচয়ই ব্যবহার করত। সাংবাদিক ও পুলিশের সঙ্গে সে নম্র ও কোমনীয় ব্যবহার করত। পালটা ভালো ব্যবহার পেয়ে, সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাত শোভরাজ। সাজা এড়িয়ে যেত। বিভিন্ন দেশে বারবার গ্রেফতার হয়েছে শোভরাজ। পাশাপাশি, ঘুষ দিয়ে ছাড়া পাওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে বারবার উঠেছে।
১৯৭৬-এ ভারতে গ্রেফতার
নয়াদিল্লিতে ১৯৭৬ সালে শোভরাজ ধরা পড়ে। শোভরাজ ও তার তিন মহিলা সঙ্গী কয়েকজন ফরাসি ছাত্রকে পীড়াপীড়ি করে তাদের ট্যুর গাইড হিসেবে নিযুক্ত হয়। এরপর তারা পর্যটকদের বিষের বড়ি খাইয়েছিল। তার মধ্যে কিছু পড়ুয়া পুলিশকে ফোন করেছিল। তাতেই ধরা পড়ে যায় শোভরাজ ও তার দলবল। বিচারে শোভরাজের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়।
তিহারের সুপারের চোখে
সেই সময় তিহার জেলের সুপার ছিলেন জেপি নাইথানি। তিনি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, 'আমি শোভরাজকে জেলের মধ্যে দেখেছি। স্থানীয় আদালতে তার আইনি লড়াই দেখেছি। সাংবাদিক ও আইনজীবীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ দেখেছি। তার কাজকর্ম দেখেছি। তার ওপর লেখা বই সার্পেন্টাইন বেস্টসেলার হয়েছিল। মহিলা ভিজিটররাও শোভরাজের সঙ্গে দেখা করতে আসত। তাদের সঙ্গে চার্লস শোভরাজের ব্যবহার ছিল দেখার মত। অনেকে বিদেশ থেকেও আসত। কেউ আবার প্রেমও নিবেদন করত। কেউ কেউ আবার বিয়েও করতে চেয়েছিল। এমনকী, অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদনও করেছিল। এমনই ছিল শোভরাজের ব্যক্তিত্ব।'
তিহার থেকে শোভরাজের পলায়ন
কিন্তু, তার সাজা শেষ হওয়ার দিকে শোভরাজ পালিয়ে যায়, কারারক্ষীদের জন্মদিনের মিষ্টি উপহার দিয়েছিল। সেই মিষ্টিতে মাদক মেশানো ছিল। পরে অবশ্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, নতুন অপরাধ করে ফের ধরা দেওয়ার জন্যই শোভরাজ ইচ্ছাকৃতভাবে পালিয়েছিল। তা-ও ১০ বছরের কারাদণ্ডের মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে। কারণ, না-হলে তাকে থাইল্যান্ডের হাতে তুলে দেওয়া হত। সেখানে পাঁচটি খুনের জন্য শোভরাজ ওয়ান্টেড ছিল। আর, থাইল্যান্ডে পৌঁছলেই শোভরাজকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। এরপর ১৯৯৭ সালে শোভরাজ যখন মুক্তি পায়, সেই সময় ব্যাংককে তার মামলা নির্দিষ্ট ২০ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। ফলে, শোভরাজও তখন বিপন্মুক্ত হয়েই জেল থেকে ছাড়া পায়।
আরও পড়ুন- নিরাপত্তার চরম অভাব! মাথা বাঁচাতে ক্রিকেটের হেলমেট পরেই সভায় বিধায়ক
নেপালে গ্রেফতার
ভারত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শোভরাজ ফ্রান্সে ফিরে যায়। ২০০৩ সালে শোভরাজ নেপালে গেলে সেখানও তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৫ সালে মার্কিন মহিলা কনি জো ব্রোঞ্জিচকে হত্যা করার জন্য ২০০৪ সালে নেপালে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে, ব্রোঞ্জিচের আমেরিকান বন্ধু লরেন্ট ক্যারিয়ারকে হত্যা করার জন্যও শোভরাজকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০১৪ সালে, শোভরাজ জানায় যে তিহার জেলে জেইএম প্রধান মাসুদ আজহারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তার জেরে সে তালিবানের সহযোগী অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করে। শুধু তাই নয়, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সঙ্গেও হাত মিলিয়ে কাজ করার দাবি করে শোভরাজ। নেপালেই শোভরাজ স্থানীয় আইনজীবী নিহিতা বিশ্বাসকে বিয়েও করে। নিহিতা ভারতীয় টিভি শো বিগ বসের সিজন ৫-এ অংশ নিয়েছিল।
Read full story in English