Advertisment

বিশ্লেষণ: ত্রিপুরায় মন্দিরে বলি নিষিদ্ধ, কী যুক্তি আদালতের

ত্রিপুরায় গত ৫০০ বছর ধরে পশু বলি প্রথা চলে আসছে। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে রাজত্ব করত মাণিক্য পরিবার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
tripura sacrifice

প্রদ্যোৎ দেববর্মণ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন পশুবলির পরিমাণ কমালেও "আদালত পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতে পারে না।"

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জয় কারোল এবং বিচারপতি অরিন্দম লোধকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ রাজ্য জুড়ে পশু ও পাখি বলি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আদালত সরকারকে "সাংবিধানিক মূল্যবোধ এবং ভালবাসা, মনুষ্যত্ব পশু পাখির প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন" করতে বলেছে।

Advertisment

দুটি বৃহৎ মন্দির কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কিত কোনও নোটিফিকেশন জারি না হবার যুক্তিতে আদালতের রায় মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে ত্রিপুরার শেষ রাজার কিরীট বিক্রম কিশোর মাণিক্যর পুত্র প্রদ্যোৎ দেববর্মণ এবং রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে আবেদন করবে বলে স্থির করেছে।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: সারা দেশে এনআরসি চালুর আগে কেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করাতে চান অমিত শাহ

রাজ্যের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী রতন লাল নাথ সোমবার জানিয়েছেন, "সরকার তার কাজকর্মের মাধ্যমে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানবে না।" প্রদ্যোৎ দেববর্মণ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন পশুবলির পরিমাণ কমালেও "আদালত পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতে পারে না।"

৫০০ বছরের ঐতিহ্য

ত্রিপুরায় গত ৫০০ বছর ধরে পশু বলি প্রথা চলে আসছে। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে রাজত্ব করত মাণিক্য পরিবার। তাদের স্থাপিত উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বর দেবী মন্দির এবং আগরতলার চতুর্দশ দেবতা মন্দিরে বলি প্রথা চলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে।

ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মাহারাজ ধান্য মাণিক্য, ১৫০১ সালে। এটি শক্তিপীঠ বলে ধরা হয়। ১৭৭০ সালে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য চতুর্দশ দেবতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেবতাদের রাজপরিবারের দেবতা বলে মনে করা হয়।

হাইকোর্ট কী বলেছে

আদালত পশুবলির ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, "এর মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনিপেক্ষতার নিহিতার্থের অভাব রয়েছে এবং ভারতীয় সংবিধানের ২৫(১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একে সুরক্ষা দেওয়া যায় না। ধর্মের স্বাধীনতা আইনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল বলে মন্তব্য করেছে আদালত।" আদালত একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে, "মন্দিরে পশুবলি সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এবং কোনও ধর্মীয় অনুশীলন ১৯৬০ সালের পশুহিংসা প্রতিষেধক আইনের উপর নয়।"

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: পাকিস্তানি মডেল কান্দিল বালোচের হত্যা ও সাজা

আবেদন হিন্দুবিরোধী নয়

সরকারের যুক্তি, ভারতের সঙ্গে ত্রিপুরায় রাজ্যের সংযুক্তির চুক্তি ছিল ত্রিপুরেশ্বরী এবং অন্যান্য মন্দিরে ঐতিহ্য অনুসারে ধর্মাচরণ চলবে। সরকার এও বলেছে,  "পশুবলি তান্ত্রিক ধারার অঙ্গ এবং হিন্দু বিরোধীরা হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত দেবার জন্য এই আবেদন করেছে, কারণ বকরি ইদের সময়ের পশুবলি নিয়ে এই চ্যালেঞ্জ আদালতে করা হয়নি।"

আদালত সরকারের এই যুক্তিকে "ভ্রান্ত" বলে বর্ণনাই শুধু করেনি, একই সঙ্গে বলেছে, "রাজ্য এ ধরনের কোনও অবস্থান নিতে পারেনা, বিশেষ করে তার পক্ষে যখন এ কথা বলার মত কোনও প্রমাণ নেই।"

আদালত বলেছে, "বকরি ঈদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পশু বলির বিষয় নিয়ে ১৯৫৮ সালে বিহারে, ১৯৯৪ সালে পশ্চিম বঙ্গে এবং ১৯৯৮ সালে মির্জাপুরে আদালত রায় দিয়েছে।"

এমনকি সেসব মামলাতে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, পশুবলি ইসলামের অঙ্গ নয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে তাকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার এ প্রথা বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন কার্যকর করতে পারে বলেও জানিয়ে দিয়েছে আদালত।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: এনপিআর কী, এ নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

 রায়ে রবীন্দ্রনাথ

আদালত বলেছে, "এখানে আমরা রাজ্যকে মনে করিয়ে দিতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিসর্জন নাট্যের মাধ্যমে তৎকালীন রাজা ও তাঁর প্রজাবর্গকে কী বার্তা দিয়েছিলেন।"

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাণিক্য রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠতা ছিল, রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথকে ভারত ভাস্কর উপাধি দেওয়াই শুধু হয়নি, তাঁকে বিশ্ব ভারতী নির্মাণে আর্থিক সহায়তাও করেছিল রাজ পরিবার। ত্রিপুরা রাজত্বের ইতিহাসের এক টানাপোডে়নের অধ্যায় লিপিবদ্ধ রয়েছে তাঁর উপন্যাস রাজর্ষিতে, যা তিনি পরে নাট্যরূপ দেন বিসর্জন নামে।

রাজর্ষি ও বিসর্জন ঘুরপাক খায় একটি সংলাপকে কেন্দ্র করে। সে সংলাপটি হল "এত রক্ত কেন?" এক বালিকার মুখে এ প্রশ্ন শোনার পর, এবং তার মৃত্যু দেখবার পর রাজর্ষি উপন্যাসের রাজা ভুবনেশ্বরী মন্দির (অধুনা দক্ষিণ ত্রিপুরার ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির) থেকে পশুবলি নিষিদ্ধ করেন। বলি প্রথার তীব্র সমর্থক পুরোহিত রঘুপতি রাজশত্রুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন এবং মুঘলদের সাহায্য নিয়ে গোবিন্দমাণিক্যকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। গোবন্দিমাণিক্য পরে আরাকানদের সাহায্যে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।

Read the Full Story in English

tripura
Advertisment