আমেরিকার টেনিস ফ্যানদের ৪ জুলাই সেলিব্রেট করার একাধিক কারণ রয়েছে। এই দিনেই শুরু হয়েছে অল আমেরিকান টেনিস টিম কাপ - প্রথম প্রদর্শনী টেনিস প্রতিযোগিতা যেখানে ম্যাচ ভেনুতে গিয়ে দর্শকদের ম্যাচ দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অতিমারীর পর প্রথম এই ধরনের সুযোগ এসেছে জর্জিয়ার আটলান্টায়।
কিন্তু এই প্রতিযোগিতা কঠোর এক বাস্তবতার দিকে ফের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, মনে করিয়ে দিয়েছে বর্তমান সময়ে কেন সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে - কারণ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্লেয়ার ফ্রান্সিস তাইফো একটি ম্যাচ খেলার আগেই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন।
বিশ্ব ক্রমপর্যায়ের ৮১ নম্বরে থাকা তাইফো হলেন পঞ্চম টেনিস প্লেয়ার, যিনি কোনও প্রদর্শনী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর ভাইরাস আক্রান্ত হলেন। অন্য চারজন হলেন নোভাক জকোভিচ, গ্রিগর ডিমিত্রভ, বোরনা কোরিক ও ভিক্টর ট্রইস্কি। এঁরা সকলেই জকোভিচের চ্যারিটি ইভেন্ট আদ্রিয়া ট্যুরে অংশ নেওয়ার পর পজিটিভ হয়েছেন।
আরও পড়ুন, মেসি কি বার্সেলোনা ছাড়ছেন?
জকোভিচের চ্যারিটি শুরু হয়েছিল ১৩ জুন। বলকানের চারটি শহরে এই প্রদর্শনী হয়। কোনও রকম নিরাপত্তা বা সামাজিক দূরত্ব না মেনেই তা অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন টুর্নামেন্ট যদিও কিছু প্রটোকল মেনে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, কিন্তু কোভিড-১৯ যখন দ্রুত হারে দেশে বাড়ছে, সে সময়েই এর আয়োজন।
ক্রোয়েশিয়ায় দ্বিতীয় লেগ শেষ হওয়ার আগেই আদ্রিয়া ট্যুর বাতিল হয়। কিন্তু আটলান্টার ক্ষেত্রে আয়োজকরা তাইফোর জায়গায় ক্রিস্টোফার ইউব্যাঙ্কসকে নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করেন এবং তিনদিনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।
কিন্তু আমেরিকায় একজন খেলোয়াড় টেনিস ইভেন্টে অংশ নেবার পর এবং আমেরিকায় ক্রমবর্ধমান রোগবৃদ্ধির কারণে সে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেনিস প্রতিযোগিতা আমেরিকান ওপেন নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে। ভারতের প্রাক্তন ডেভিস কাপ অধিনায়ক আনন্দ অমৃতরাজ এখন লস এঞ্জেলেসের বাসিন্দা। তাঁর কথায়, "এখনই আমি নিশ্চিত নই কী হতে চলেছে। আমার মতে, মনে হয় আমেরিকান ওপেন সুতোয় ঝুলছে।"
আমেরিকায় এখন কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কীরকম?
আমেরিকান ওপেনের আয়োজন USTA ১৬ জুন জানিয়েছে গ্র্যান্ড স্লাম হবে। তার পর থেকে, সারা দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি মারাত্মক।
৪ জুলাইয়ের তথ্য অনুসারে গত ১৮ দিনে আমেরিকায় নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ৭২৪৩৬৪ জন। ১৬ জুন সক্রিয় সংক্রমণের পরিমাণ ছিল ১১৬৩৭৫০, ৪ জুলাই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪৩০৪৭।তবে আমেরিকান ওপেন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নিউ ইয়র্কে। শুরুতে নিউ ইয়র্কই রোগের ভরকেন্দ্র হলেও ১৬ জুনের পর থেকে সেখানে পরিস্থিতি ভালোর দিকে।
সংক্রমণের মোকাবিলায় ত্রাণকার্যের জন্য আমেরিকান ওপেন যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেই ৪২ একরের বিলি জিন কিং ন্যাশনাল টেনিস সেন্টার খুলে দিয়েছে USTA। ১৪ হাজার আসনের লুই আর্মস্ট্রং স্টেডিয়ামকে কমিশারিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে যেখানে ২৫ হাজার জনের খাবার প্যাক করা যেতে পারে।
অল আমেরিকান টিম টেনিস কাপ বা আদ্রিয়া ট্যুরের ক্ষেত্রে কোনও প্রটোকল ছিল কি?
আটলান্টা ইভেন্টের ওয়েবসাইট অনুসারে সীমিত সংখ্যক ফ্যান (শনিবার হাজির ছিলেন ৪৫০ জন)-কে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত দর্শকদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার কথা এবং ১০০.৪-এর নিচে তাপমাত্রা থাকলে তবেই তাঁকে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নয়, তবে চাইলে পাওয়া যাবে। দর্শকদের পরস্পরের মধ্যে ৬ ফিট দূরত্ব রেখে বসার ব্যবস্থা হয়েছে।
আদ্রিয়া ট্যুরে কোনও প্রটোকল ছিল না। খেলোয়াড়দের পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতে ও হাই ফাইভ করতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের প্রদর্শনী ফুটবল ও বাস্কেটবল ম্যাচে অংশ নিতে ও পার্টিতে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দর্শকদের মাস্ক পরার ব্যাপারে বাধ্যবাধ্যকতা ছিল না, তাঁদের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বের ব্যাপারও ছিল না।
এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে তা হল ১৬ জন মহিলা প্রতিযোগীকে নিয়ে প্রদর্শনী, যাতে অংশ নিয়েছিলেন দুবারের অস্ট্রেলিয় ওপেন বিজয়িনী ভিক্টোরিয়া আজারেঙ্কা, ২০১৭ সালের আমেরিকান ওপেন চ্যাম্পিয়ন সোলেন স্টিফেনস এবং শেষবারের অস্ট্রেলিয় ওপেন বিজয়িনী কোফিয়া কেনেন। ২৩ জুন এই প্রদর্শনী শুরু হয় দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটনে।
আনন্দ অমৃতরাজের পুত্রবধূ অ্যালিসন রিস্ক এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সাইডলাইনের ধার থেকে তাঁকে খেলতে দেখা আনন্দ বলছিলেন, "১০ হাজার সিটের স্টেডিয়ামে মাত্র ৫০ জন দর্শককে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, তাও মূলত পরিবারের লোকজন। একজন আম্পায়ার, দুদিকে একজন করে বল বয়, নিজের লাইন কল নিজের। মনে হচ্ছিল যেন জুনিয়র ইভেন্ট। এক বল দ্বিতীয়বার ছোঁয়া যাবে না, একবার কোর্ট ছেড়ে বেরোলে মাস্ক পরতে হবে ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, করমর্দন করা যাবে না। সকলেই খুবই সাবধানী। ফলে দেখাই গেল ব্যাপারটা নিরাপদে করা সম্ভব। তবে আমেরিকান ওপেন তুলনায় অনেক বড় ব্যাপার।"
আমেরিকান ওপেনের নিরাপত্তা প্রটোকল নিয়ে কী বলা হয়েছে?
আমেরিকান ওপেন শুরু হওয়ার কথা ৩১ অগাস্ট। ভেন্যুতে কোনও দর্শক প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। বিদেশ থেকে যেসব খেলোয়াড় আসবেন, এবং তাঁর যে একজন সঙ্গী, তাঁদের নিউ ইয়র্কের বিমানে চড়ার আগে কোভিড-১৯ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। পৌঁছনোর পর ফের তাঁদের পরীক্ষা করা হবে এবং নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হবে। খেলোয়াড়দের আসা যাওয়া হোটেল ও স্টেডিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
সিঙ্গলসে কোনও কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড থাকবে না। ডবলসের খেলা ৬৪ থেকে ২৪টি টিমে নামিয়ে আনা হবে।
এই মূহূর্তে নিউ ইয়র্ক প্রশাসন নিউ ইয়র্কের সমস্ত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ভ্রমণকারীদের ১৪ দিনের কোয়ারান্টিন বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করেছে।
ফ্রেঞ্চ ওপেনও কি রুদ্ধ স্টেডিয়ামে হবে?
এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে তা হল ফ্রেঞ্চ টেনিস ফেডারেশন ২৬৭ সেপ্টেম্বর থেকে টুর্নামেন্ট শুরু করতে চায়। তারা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দর্শকের প্রবেশের অনুমতি দেবে, যা দিনপ্রতি প্রায় ২০ হাজার।
অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর অর্থ তিনটি শো কোর্টে বসার ব্যবস্থা হবে নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে। প্রতিটি রো-তে এক একটি করে ক্রেতা গ্রুপের (চারজনের বেশি এক গ্রুপে রাখা যাবে না) মধ্যে একটি করে আসন খালি থাকবে। বাইরের কোর্টে দুটি আসনের একটি বন্ধ থাকবে, দর্শকরা বাকি আসনগুলিতে যেখানে খুশি বসতে পারেন।
প্লেয়াররা প্রটোকল ভাঙতে পারেন, এমন ভয় কি পাচ্ছেন সংগঠকরা?
আদ্রিয়া ট্যুর শেষ হওয়ার পর বিশ্বের সাত নম্বর ক্রমপর্যায়ের আলেকজান্ডার জেভেরেভ কোভিড পরীক্ষায় নেগেটিভ হন। কিন্তু তাঁর সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে তিনি সেলফ আইসোলেশনে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তবে কয়েকদন পরেই দেখা যায় জার্মান এই টেনিস তারকা কোয়ারান্টিন প্রটোকল ভেঙে ফ্রান্সে এক পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন।
আনন্দ অমৃতরাজও বলছেন খেলোয়াড়দের প্রটোকল ভাঙার আশঙ্কা সংগঠকদের মাথা ব্যথার কারণ।
"এ কথা ভাবতেই হবে কারণ অন্তত ৩০০ জন নিয়ে গোটা ব্যাপার। এর পর তাঁদের সঙ্গে আরও ৩০০ জন লাগবে সবটা মনে করানোর জন্য। এটা অনেকটা বেবিসিটিংয়ের মত। যতক্ষণ না নজরদারি করার কেউ একজন থাকছে, আমার ধারণা, কেউ না কেউ নিয়ম ভাঙবেই। এদের উপর নজর রাখার জন্য সবসময়ে কাউকে রাখতে হবে. আমি জানি না USTA সে ব্যাপারে কতটা প্রস্তুত।"
USTA আমেরিকান ওপেন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কেন?
এক কথায়- অর্থ।
উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপ এ বছর বাতিল হওয়ায় LTA প্রায় ২৫০ মিলিয়ন পাউন্ড পেয়েছে, কাপণ তাদের বিমা পলিসিতে অতিমারীর কভারেজ ছিল। আমেরিকান ওপেন বা ফ্রেঞ্চ ওপেনের তেমন কোনও বিমা নেই।
"USTA-র সারা বছরের বাজেটের অধিকাংশ অর্থই আসে আমেরিকান ওপেন থেকে। যদি আমেরিকান ওপেন বাতিল হয়, তাহলে ওদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। সে কারণেই ওদের এত আগ্রহ।" বললেন আনন্দ অমৃতরাজ।