/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/trump-modi.jpg)
ছবি- হোয়াইট হাউস
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যত আহ্লাদের সঙ্গে ভারতে আবাহন করা হল, ১৯৫০ সাল থেকে তেমনটা আর ঘটেনি। তাও এমন একটা পর্যায়ে যখন ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক ও বিতর্কিত।
এখনকার দিনে সফরকারী নেতার সঙ্গে জনসমাবেশ প্রায় হয় না বললেই চলে, তবে ১৯৫০-এ সেটাই ছিল নিয়ম। তখন চিনের প্রধান চৌ এন লাই, রাশিয়ার নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে যোগ দিতেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
ভারতে দারিদ্র্য: ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা ও বাস্তব
১৯৫০-এ ভারত সদ্য তৈরি হওয়া একটি দেশ। তখন দেশ চেষ্টা করছে নতুন নতুন আন্তর্জাতিক সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখার। ট্রাম্পের ঐতিহাসিক আবাহনের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার অংশীদারি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যেটুকু আপত্তির পরিবেশ ছিল সেটুকুরও অবসান ঘটতে চলেছে।
মোতেরা ও দিল্লিতে ট্রাম্পকে যে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট ভারতের আমেরিকা সম্পর্কে মনোভাব কীরকম। গত দু দশক ধরে সম্পর্কের উন্নতি ঘটলেও দেশের আমলাতন্ত্রে, রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যে ও ইন্টেলেজেনশিয়ায় আমেরিকার প্রতি ব্যাপক অবিশ্বাসের বাতাবরণ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক পূর্বসূরীরা, পিভি নরসিমা রাও, অটল বিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং, সকলেই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অগ্রগতি ঘটাতে উন্মুখ ছিলেন, কিন্তু সকলেই গভীর আভ্যন্তরীণ প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন।
বিশ্লেষণ: ইন্দো-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
আমেরিকার সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক অংশীদারিত্ব যেমন মূল স্রোতের কাছে ছিল বিদেশ নীতি থেকে বিচ্যুতি। রাশিয়া বা চিনের সঙ্গে যা সম্পূর্ণত যথার্থ, তা আমেরিকার সঙ্গে ঘটলে বেঠিক। বা অন্যভাবে বললে, রাশিয়া ও চিনের সঙ্গ প্রগতিশীল ও আমেরিকার সঙ্গ পশ্চাৎপদ।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/02/trump-modi-love.jpg)
শেষ পর্যন্ত মোদী আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সংস্কারের নিগড়টা ভেঙেছেন।
২০১৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেবার সময়ে মোদী দাবি করেছিলেন, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসক সংশয়ের কাল পেরিয়ে গিয়েছে। সে ঘোষণা যদি ইঙ্গিত হয়, তাহলে মোতেরা সে রূপান্তরের প্রমাণ।
ট্রাম্পের ভারত আগমন ও ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি
আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের পক্ষে সবচেয়ে জরুরি, মোদীর এই ঘোষণার ভিত্তি ছিল দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিশ্বাসের নয়া মাত্রা। মার্কিন অংশীদারিত্বের ব্যাপারে পুরনো সব সংস্কার কেটে গেল এর মাধ্যমে। আর এই বিশ্বাসের জায়গা ধরেই মোদী ভারত-মার্কিন নতুন সম্ভাবনাকে জনসমক্ষে তুলে ধরলেন।
সংশয়ীরা এখনও বলে যাবেন যে ভারত আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বের ব্যবহারে আবেগপ্রবণ। তাঁদের হয়ত মনে থাকবে ভারতের সঙ্গে ৫-এর দশকে চিনের সম্পর্কের গভীরতা, যা প্রকাশ হয়েছিল হিন্দি-চিনি ভাই ভাই স্লোগানের মাধ্যমে। সে ভাবাবেগ এক দশকের মধ্যেই চুরমার হয়ে পড়ে তিব্বত, এলাকা দখল ও অন্যান্য ইস্যুতে।
মোদীর কথাই কি ঠিক, দেশভাগের পর সত্যিই হিন্দু ও মুসলিম শরণার্থীদের মধ্যে বিভাজন করা হয়েছিল?
ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর কৌশলগত গলাগলি অনেকটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের মত। যদিও হিন্দি-রুশি ভাই ভাই স্লোগান সে সময়ে ওঠেনি, তা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যৌথতা কয়েক দশখ ধরে ভারতের বিদেশনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে থেকে গিয়েছিল।
এ সপ্তাহে ট্রাম্পের সফর আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই বুলগানিনের ভারত সফরের কথা। এই দুই রাশিয়ান নেতা তামিল নাড়ুর উটি থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত যেখানেই গিয়েছিলেন ব্যাপক মানুষ তাঁদের দেখতে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৫০-এ আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল, সে দেশের নেতারা ভারতে যে উষ্ণতার আঁচ পেয়েছিলেন তাতে দারুণ খুশি হয়েছিলেন।
ট্রাম্পের সফর অনেকটা ক্রুশ্চেভের সফরের মতই, যদি কাশ্মীরকে লক্ষ্য করা যায়। শ্রীনগরের জনসভায় রাশিয়ান নেতারা কাশ্মীর নিয়ে ভারতের পক্ষে দৃঢ়ভাবে সমর্থন পোষণ করেন। সে সময়ে ব্রিটিশ ও মার্কিনরা রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপকভাবে ভারতের উপর চাপ দিচ্ছিল। কাশ্মীর নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে বারবার রাশিয়ার ভেটো দানের ফলে দিল্লি ও মস্কোর সম্পর্কে উন্নতির যত বড় কারণ, তেমনটা অন্য কিছু নয়।
ট্রাম্পের মধ্যস্থতা করবার অত্যাগ্রহের মধ্যে ভারত একটা জিনিস খেয়াল করেনি। কাশ্মীর নিয়ে দিল্লি যে পরিমাণে হোয়াইট হাউসের সমর্থন পেয়েছে এবং পাকিস্তানের উপর আমেরিকা যেভাবে সীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধ করবার ব্যাপারে চাপ দিয়েছে।
গত অগাস্টে ভারত কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদার বদল ঘটাবার পর পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার জন্য ক্রমাগত যে চাপ সৃষ্টি করে গেছে, তার প্রেক্ষিতে আমেরিকার সমর্থন ভারতের পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে পাকিস্তানের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যাওয়াও ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর নিয়ে মোদীর অবস্থানে ট্রাম্পের নিহিত সমর্থনের কথাও উল্লেখ করা জরুরি। অগাস্ট মাস থেকে আমেরিকা কাশ্মীরের সাংবিধানিক পরিবর্তন নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলেনি।
কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে চিনের সমর্থনের সময়ে ভারতের পাশে আমেরিকার দাঁড়ানো এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের পক্ষে থাকা, এ দুইই ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটি দিক। আরেকটি দিক স্বয়ং চিন।
৫-এর দশকে কাশ্মীর ইস্যুতে সমর্থন সোভিয়েত রাশিয়াকে যেমন ভারতের কাছে এনেছিল, তেমনই ৬-এর দশকে মস্কো ও বেজিংয়ের মধ্যে ঝামেলার জেরে ভারতের ইন্দো-সোভিয়েত সম্পর্ক পোক্ত হয়। বর্তমানে ওয়াশিংটন ও বেজিংয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ও ভারত চিনের সম্পর্কের ভারসাম্য হানি দিল্লি ও আমেরিকাকে এশিয় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই কাছাকাছি এনেছে।
গত দু দশকে জর্জ বুশ ও বারাক ওবামা ভারতের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প জমানাতেই ওয়াশিংটন ভারতের সঙ্গে প্রযুক্তি রফতানি থেকে কাশ্মীর ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুর মত বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
আমেরিকার অনেক পুরনো মিত্ররাই যেমন ট্রাম্পকে আমেরিকার রাজনীতির বিপথগামী চরিত্র হিসেবে ধরে নিচ্ছে। সে সময়েই মোদী আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সম্ভাবনার দুয়ার দেখতে পয়েছেন, যে দুয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
আমেরিকার অনেক বন্ধুরাই যা করেনি, মোদী সরকার তাই করেছে। রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে হিউস্টনে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের সময়ে হাউডি মোদী সমাবেশে সমর্থন জানিয়েছিল তারা। এর ফলে আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ক্ষোভ সূচিত হয়েছে। কিন্তু মূল ঝুঁকি ওয়াশিংটনে নেই, আছে দিল্লিতে। যুদ্ধরত ভারত কিন্তু হিন্দি-আমেরিকি ভাইভাইয়ের সুবর্ণ সুযোগ নিতে পারবে না।