ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে ভারতীয়রা এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। নৃশংসভাবে সেই সমাবেশ ভেস্তে দেওয়া হয়েছিল। যা হয়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক বর্বরতার করুণতম স্মৃতি।
রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার নামে একজন ব্রিটিশ কর্নেল সৈন্যদের বাড়ি এবং সরু গলির মাঝখানে অবস্থিত ওই কম্পাউন্ড ঘিরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি, সমাবেশে অংশ নেওয়া পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। অংশগ্রহণস্থল চারপাশ থেকে ঘেরা হওয়ায় অংশগ্রহণকারীদের পালানোর কোনও উপায় ছিল না।
তাঁদের মধ্যে কয়েকজন গুলি থেকে বাঁচতে ওই চত্বরের মধ্যে অবস্থিত একটি কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের মতে, গুলিবর্ষণে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি ছিল নয় বছরের এক শিশু। আর, সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন ৮০ বছর বয়সি একজন। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মতে অবশ্য নিহতের সংখ্যা ছিল অন্তত ১,০০০।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন জালিয়ানওয়ালাবাগের আগে এবং পরেও অসংখ্য নৃশংসতার উদাহরণ তৈরি করেছে। কিন্তু, জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র অসামরিক ব্যক্তিদের ওপর যে নৃশংসতা ঘটেছিল, তা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। তার মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল দিনটিকে 'দানব' হিসেবে নিন্দা করেছিলেন। আর, ডায়ারের আদেশের তদন্তের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগে কী হয়েছিল?
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল বৈশাখের শিখ উত্সব ছিল। যা বসন্তের অবসান এবং শীতের ফসল কাটার সূচনার প্রতীক। একইসঙ্গে, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতার আন্দোলন সেই সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। যার জেরে রাওলাট বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জালিয়ানওয়ালাবাগে ঔপনিবেশিক নির্দেশ অমান্য করে বাসিন্দারা জড় হয়েছিলেন।
কারণ, রাওলাট আইন ভারতীয়দের নাগরিক স্বাধীনতাকে খর্ব করেছিল। আর, ঔপনিবেশিক বাহিনীকে কোনও পরোয়ানা বা বিচার ছাড়াই লোকেদেরকে গ্রেফতার করার সুযোগ দিয়েছিল। নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের আপত্তি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের মাধ্যমে এই বিল উত্থাপন করা হয়েছিল। যার ফলে ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। এর জেরে দিল্লি, বম্বে (বর্তমানে মুম্বই) এবং লাহোরে বিক্ষোভ হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল। সেই সময় গান্ধীজি একটি অহিংস শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
স্যার মাইকেল ও'ডায়ার ১১ এপ্রিল লাহোর এবং অমৃতসরে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। কিন্তু, তাঁর আদেশটি ১৪ এপ্রিল অমৃতসরে পৌঁছেছিল। তিনি কর্নেল ডায়ারকে, যিনি তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের অস্থায়ী পদে ছিলেন, জলন্ধর সেনাছাউনি থেকে অমৃতসরে পাঠান। এর মধ্যে ১৩ এপ্রিল, এক রবিবার, কর্নেল ডায়ারের সৈন্যরা চার জনের বেশি লোকের সমাবেশের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করতে অমৃতসর শহরের মধ্যে দিয়ে একটি মিছিল করেছিল। সেই ঘোষণা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পৌঁছয়নি। ফলে, যথারীতি বহু শিখ ভক্ত স্বর্ণ মন্দিরের দিকে রওনা হয়েছিলেন। বিকাল ৪টা নাগাদ, রাউলাট আইনের বিরোধিতা করার জন্য ড. সত্যপাল এবং ড. সইফুদ্দিন কিচলুকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে জনসভার জন্য অনেকে জড় হয়েছিলেন।
ডায়ার এই সমাবেশকে সরকারি আদেশের লঙ্ঘন হিসেবে দেখেছিলেন। ডায়ার ১৯২০ সালে তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য তৈরি হান্টার কমিটিকে (ডিসঅর্ডার কমিটি) বলেছিলেন, 'ওরা যুদ্ধ করতে এসেছিল। ওরা আমাকে অস্বীকার করেছিল। তাই আমি ওদের শিক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি একটা বিস্তৃত ছাপ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম।' তাঁর সৈন্যদের নিয়ে, ডায়ার একটি সরু গলির মধ্যে দিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সরু গলিই ছিল বাগে প্রবেশ ও প্রস্থানের একমাত্র পথ।
১৯২০ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডায়ার ২৫ জন গোর্খা সৈন্য এবং ২৫ জন রাইফেলে সজ্জিত সেনা, ৪০ জন খুকরি-সহ গোর্খা সৈন্য এবং দুটি সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রবেশ করেছিলেন। এসময় সেখানে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার লোক জড়ো হয়েছিলেন। সেই সময় ভিতরে উপস্থিত কারও কাছে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারও কারও হাতে কেবলমাত্র লাঠি ছিল। সেই উপস্থিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য কোনওরকম সতর্কতার ঘোষণা করেননি ডায়ার। কারণ, তাঁর সেটা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল। ডায়ার তাঁর সৈন্যদের গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় ১০ মিনিট ধরে গুলি চলেছিল।
সব মিলিয়ে ডায়ারের সৈন্যরা ১,৬৫০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। পরবর্তী তদন্তে দেখা গিয়েছে যে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯। আহতদের কোনও পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। মনে করা হয়েছিল যে আহতদের সংখ্যা মৃতের তিনগুণ। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় নেতারা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন।
জেনারেল ডায়ার কে ছিলেন?
ডায়ার বর্তমান পাকিস্তানের মুরিতে ১৮৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর, ১৮৮৫ সালে ওয়েস্ট সারে রেজিমেন্টে অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বদলি হন। এরপর ১৮৮৬-৮৭ সালে মায়ানমারে নিযুক্ত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) পূর্ব পারস্য ঘেরাও করার দায়িত্ব পান। এই ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে জার্মানদের অগ্রগতি প্রতিরোধ করা।
জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা বিশেষভাবে তার বর্বরতার প্রতি সকলের মনোযোগ কেড়েছিল। এই ঘটনার পরও, ডায়ার অন্ততপক্ষে একটি ঘটনায় ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের ১০ এপ্রিল, মার্সেলা শেরউড নামে এক ধর্মপ্রচারক, রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। স্থানীয় কয়েকজন হস্তক্ষেপ করে তাঁকে উদ্ধার করেন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ছয় দিন পর, ডায়ারকে জানানো হয়েছিল কীভাবে শেরউডকে আক্রমণ করা হয়েছিল। এরপর তিনি একটি আদেশ জারি করেছিলেন যে শেরউডকে যে রাস্তায় আক্রমণ করা হয়েছিল, সেই রাস্তা দিয়ে কেউ হাঁটবে না। যাঁদের এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তাঁদের হামাগুড়ি দিতে বলা হয়েছিল। এই আদেশ অমান্যকারীদের বেত্রাঘাত করা হয়েছিল।
হান্টার কমিটির রিপোর্টের অংশ হিসেবে, ডায়ারের দেওয়া বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। যাতে দেখা গিয়েছে, তিনি ১৩ এপ্রিলের বর্বরতার জন্য বিশেষ অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে জনতাকে দমন করা নিয়ে তাঁর কার্যকলাপ ন্যায়সঙ্গত ছিল। রিপোর্টে ডায়ারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, 'আমি আমার মন তৈরি করেছিলাম। আমি শুধু ভাবছিলাম যে আমার এটা করা উচিত কি না। পরিস্থিতি খুবই গুরুতর ছিল। আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে যদি তারা মিটিং চালিয়ে যেতে চায়, আমি সব লোককে গুলি করে মেরে ফেলব।'
কেন তিনি এত পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করেছিলেন? তার উত্তরে ডায়ার বলেছিলেন যে, 'হ্যাঁ, আমি মনে করি এটা খুব সম্ভব যে আমি গুলি না-চালিয়েও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারতাম। আমি কিছু সময়ের জন্য তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পারতাম। তখন তারা সবাই ফিরে এসে আমাকে নিয়ে হাসত। আমি ভেবেছিলাম যে আমি নিজেকে বোকা বানিয়ে ফেলব। তারা যুদ্ধ করতে এসেছিল। যদি তারা আমাকে অস্বীকার করে, সেই ভাবনা থেকেই আমি তাদের একটা শিক্ষা দিয়েছিলাম। আমি তাদের শাস্তি দিয়েছিলাম। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটা ছাপ তৈরি করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।'
রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে ডায়ারের ব্যবহৃত শক্তি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ছিল। সেকথা জানানো হলেও, কর্তব্যবোধের ধুয়ো তুলে ডায়ারের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও করা হয়েছিল। হান্টার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, 'অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে একজন সৈনিক হিসেবে তাঁর আদেশ ছিল কঠোর। তবে, তা কর্তব্যবোধের ভুল ধারণার দ্বারা চালিত হয়েছিল। যা ছিল ক্ষতিকর। কিন্তু, তা বিশৃঙ্খলার শক্তিকে দমন করেছিল। তাই আমরা দুঃখের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, একজন সৈনিক হিসেবে জেনারেল ডায়ারের বিশিষ্ট রেকর্ড আছে। সাম্প্রতিক আফগান যুদ্ধের সময় থালের গ্যারিসনে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমরা যেন ভুলে না-যাই।'
আরও পড়ুন- ঘুমন্ত চার জওয়ান খুন, নৃশংসতার সাক্ষী ভাতিন্দা সেনা ছাউনি কীভাবে তৈরি হল?
জালিয়ানওয়ালাবাগের পর ডায়ারের কী হয়েছিল?
হান্টার কমিটি ঘটনার নিন্দা করলেও ডায়ারকে কোনও শাস্তি দেয়নি। উলটে ডায়ার জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত, সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারকে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তার পদ থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। ডায়ারকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি ভারতে আর চাকরি করতে পারবেন না।
যাইহোক, ডায়ার সেই সময় একজন বিভাজনকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দেশে সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতে অস্থিরতা রোখার নাম করে ডায়ারের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিল। ব্রিটেনের রক্ষণশীল সংবাদপত্র এবং সংস্থাগুলো পরে ডায়ারের জন্য একটি আর্থিক তহবিলের ব্যবস্থা করে। তাঁর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিল।
এসব দেখে এক ব্রিটিশ জনপ্রতিনিধি ও পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন যে ডায়ারের কাজের পুনরাবৃত্তি কখনও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তিনি বলেছিলেন, 'ভারতে বা অন্য কোথাও আমাদের শাসন কখনও শারীরিক শক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তেমনটা হলে, তা হবে মারাত্মক।' শেষ পর্যন্ত ডায়ার অবসর নিতে বাধ্য হন। তিনি ব্রিটেনে ফিরে যান।
এর মধ্যেই ঘটনাচক্রে অন্য ডায়ার, অর্থাৎ সামরিক আইন লাগু করার আদেশ দেওয়া অফিসার মাইকেল ও'ডায়ার, পরে ১৯৪০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ব্রিটেনে অবসর গ্রহণের পর তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় বিপ্লবী উধম সিং গুলি করে মাইকেল ও'ডায়ারকে হত্যা করেছিলেন। বিভিন্ন তথ্যে জানা গিয়েছে যে উধম সিং তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে প্রায়শই ও'ডায়ারকে ডায়ার হিসেবে উল্লেখ করতেন। তার ফলে রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার আর মাইকেল ও'ডায়ারের মধ্যে তিনি পার্থক্য করতে পারেননি। তার ফলেই ভুল করে মাইকেল ও'ডায়ারকে জেনারেল ডায়ার ভেবে হত্যা করেছিলেন।