নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সংসদে পাশ হওয়ার পর বারবার অভিযোগ উঠছে এই নতুন আইন আসাম চুক্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে।
আসাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল ভারত ও আসাম সরকার, আসু এবং সারা আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৮৫ সালের ১৫ অগাস্ট নয়া দিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর ৬ বছরের আন্দোলন সমাপ্ত হয়। ১৯৭৯ সালে আসু এই আন্দোলনের সূচনা করেছিল। তাদের দাবি ছিল অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে হবে।
ক্যাব: আসাম কেন জ্বলছে?
আসাম চুক্তি কোন পরিস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল?
আসামে বিদেশি সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের পৌঁছতে উদগ্রীব ছিল সব পক্ষ। আসু ১৯৮০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানায় আসামে বিদেশি নাগরিকদের ক্রমাগত অনুপ্রবেশ এবং তার জেরে রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক জীবনের উপর যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে তা নিয়ে তারা চিন্তিত।
ইন্দিরা গান্ধী আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। এবং ১৯৮০-৮৩ সময়ে আলোচনা প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে ফের আলোচনা শুরু হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজী গান্ধী। এর আগে ১৯৮৪-তে বেসরকারি স্তরে কয়েক রাউন্ড আলোচনা হয়।
শেষ পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৮৫ সালের শেষে। "সাংবিধানিক ও আইনি বিষয়, আন্তর্জাতিক চুক্তি, জাতীয় দায়বদ্ধতা ও মানবিক বিষয়ের সমস্যা মাথায় রেখে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।"
আসাম চুক্তিতে কোন বিষয়ে সহমত হওয়া গিয়েছিল?
এই চুক্তির মূল ছিল বিদেশি ইস্যু (৫নং ধারা), এবং রক্ষাকবচ ও আর্থিক উন্নয়ন (৬ ও ৭ নং ধারা)। এ ছাড়া কিছু অন্য ইস্যু (৮-১২ ধারা) এবং স্বাভাবিকতা ফেরানো (১৩ ও ১৪ নং ধারা)।
ক্যাব বিতর্কে পশ্চিমবঙ্গ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?
চুক্তি বাস্তবায়িত করার দায়িত্বে ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। ১৯৮৬ সালে আসাম সরকার নতুন এক বিভাগ খোলে, তার নাম আসাম চুক্তি রূপায়ণ বিভাগ। এর কাজ ছিল চুক্তির বিভিন্ন উপধারা প্রয়োগ করা।
ওয়েবসাইটে আসাম সরকার বলেছিল "আসাম চুক্তি বিভাগ, আসাম চুক্তির বিভিন্ন ধারা যা ভারত সরকার ও আসাম সরকার বিভিন্ন বিভাগ বা সংস্থার হাতে দিয়েছে তার দেখভাল করা এবং আসু, ভারত সরকার, আসাম সরকার এবং আসাম চুক্তি রূপায়ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সংযোগসাধন করা।"
বিদেশি সমস্যা নিয়ে কোন বিষয়ে সহমত হওয়া গিয়েছিল?
"বিদেশিদের চিহ্নিত করা এবং বাদ দেবার জন্য ১.১.১৯৬৬ তারিখটিকে ভিত্তি করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ১.১.১৯৬৬-র আগে যাঁরা আসাম এসেছেন এবং ১৯৬৭র ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের নিয়মিতকরণ করা হবে।"
"১.১. ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত যাঁরা ভারতে এসেছেন ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন এবং বিদেশি ট্রাইবুনাল অর্ডার, ১৯৬৪ অনুসারে তাঁদের চিহ্নিত করা হবে এবং তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।"
"এ ধরনের ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট জেলায় রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে ১৯৩৯ সালের রেজিস্ট্রেশন অফ ফরেনার্স অ্যাক্ট এবং ১৯৩৯ সালের রেজিস্ট্রেশন অফ ফরেনার্স রুলসের বিধি মোতাবেক নিজেদের পঞ্জীকরণ করাতে হবে।"
কোথায় কোথায়, কেন লাগু হবে না ক্যাব?
"চিহ্নিতকরণের ১০ বছর পেরিয়ে গেলে যেসব ব্যক্তিদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল, তাঁদের নাম আবার ফিরিয়ে আনা হবে। যাঁরা আগে বহিষ্কৃত হবার পর ফের বেআইনিভাবে আসামে প্রবেশ করেছিলেন তাঁদের আসাম থেকে বহিষ্কার করা হবে।"
আসাম চুক্তির ৬ নং ধারা নিয়ে এত আলোচনা কেন?
৬ নং ধারায় অসমিয়া মানুষের সুরক্ষাকবচের কথা বলা রয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে, "অসমিয়া মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভাষিক পরিচয়ের সুরক্ষা দেবার জন্য এবং তার উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম সাংবিধানিক, আইনি ও প্রশাসনিক সুরক্ষাকবচ দেওয়া হবে।"
রাজ্য জোড়া আন্দোলন প্রশমিত করতে সরকার এই ধারার উল্লেখ করছে। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, ক্যাব লাগু হলে বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীরা অমুসলিম হলেই এখানকার নাগরিক হয়ে যাবেন, এবং আসাম জুড়ে রাজত্ব করবে ভিনদেশিরা।
১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসামবাসীকে বরাভয় দিয়ে যে টুইট করেছেন, তাতে তিনি ৬ নং ধারার কথা উল্লেখ করেছেন।
আসাম চুক্তি রাজ্য তার বাসিন্দাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আসামের আধুনিক ইতিহাসের হিংসা ও উদ্বেগের এক পর্যায়ের শেষ ঘোষণা করেছিল আসাম চুক্তি। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল যুবসমাজ, যারা রাজ্যে বেআইনি বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান অনুপ্রবেশকে নিজেদের ভবিষ্যতের কাঁটা হিসেবে দেখেছিল।
আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা প্রফুল্লকুমার মহান্ত পরে মুখ্যমন্ত্রী হন, ভৃগু কুমার ফুকন হন রাজ্যের মন্ত্রী। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়ালও প্রফুল্ল মহান্তের মতই আসুর প্রাক্তন সভাপতি ছিলেন।
আসাম সরকার আসাম আন্দোলনকে "ঐতিহাসিক" বলে বর্ণনা করেছে এবং "উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতের খ্যাতনামা আন্দোলন" বলে অভিহিত করেছে।
সরকার বলেছে, "৬ বছরের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে ৮৫৫(পরে আসুর দেওয়া তথ্যানুসারে ৮৬০) জন জীবন দিয়ে অনুপ্রবেশমুক্ত আসামের আশা জিইয়ে রেখেছেন।"