একেই বলে শাপে বর! কোভিডের কোপে জারি লকডাউন। তার জেরেই কমছে অ্যাজমা। বিশেষ করে শিশুদের। শ্বাস-প্রশ্বাসের এই অসুখ কমেছে হু হু করে। মাস্ক ব্যবহারের ফল যেমন মিলেছে, সেই সঙ্গে লকডাউনের বাতাস নিষ্কলুষ হওয়ায় একটু সুস্থির শ্বাস।
সংখ্যার পতন
প্যানডেমিক শুরুর আগে ৬০ শতাংশ শিশুকে ডাক্তারের কাছে যেতে হত শ্বাসযন্ত্রের রোগে। এর মধ্যে বেশির ভাগেরই অ্যাজমা। প্যানডেমিক শুরুর পর থেকে অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা কমে গিয়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বলছেন গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ ইন্ডিয়ার ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ সেকশনের ডা. সন্দীপ সালভি।
সন্দীপবাবুর কথায়, সার্স কোভ-টু ভাইরাসের দাপটে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়ছে। অ্যাজমার মতো অসুখে করোনা আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়াটা আশীর্বাদের মতো। শিশু ও অ্যাজমা বিশেষজ্ঞ ডা. গৌরব শেঠি হাওয়া-বাতাসের কথা বলছেন, লকডাউনে পরিবেশের হাল অনেক ভাল হয়ে উঠেছে, বুঝতেই পারছেন তাতেই অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা কমে গিয়েছে।
কারণ আরও বিশ্লেষণ
লকডাউনের ফলে বন্ধ হয়েছে স্কুল। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হচ্ছে খানিকটা। এর ফলে শিশুরা অনেক কম বাইরে বেরচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রমও অনেক কমেছে তাদের। সেটাও অ্যাজমা হ্রাসের একটা কারণ। এমনটাই বলছে বিএমজে ওপেন জার্নালের একটি গবেষণা প্রবন্ধ। সিঙ্গাপুরে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা নিয়ে প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ইউরোপিয়ান রেসপিরেটরি জার্নালে। সেখানেও বলা হয়েছে, কোভিডের ফলে গণস্বাস্থ্যে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাতেই অ্যাজমার রোগীর সংখ্যা কমেছে। প্রবন্ধ বলছে: রাস্তায় মোটর গাড়ির সংখ্যা কমেছে এই সময়ে। বিভিন্ন কলকারখানাও বন্ধ। অ্যাজমা-বিশ্বে সু-প্রভাব পড়েছে তারই।
আরও পড়ুন জিকা ভাইরাস ছড়াচ্ছে, কতটা ভয়ের কারণ এই অসুখ?
স্কুল বন্ধের কেন হ্রাস
তবে ডা. সালভি স্কুল বন্ধ থাকাকে অ্যাজমা হ্রাসের বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। স্কুলে না যাওয়ার ফলে শিশুদের একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায়। স্কুল থেকে হাজির হওয়া শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাল সংক্রমণ অনেক সময় অ্যাজমার কারণ। স্কুলে তালা পড়ায় সেই সম্ভাবনা নেই। তাই অ্যাজমাতেও তালা পড়েছে খানিক। বিভিন্ন দেশ থেকে একই ধরনের পর্যবেক্ষণ উঠেছে এসেছে। যা রীতিমতো স্বস্তিদায়ক। (স্কুল-বন্ধে ছোটদের মানসিক হাল বেগতিক হাল হলেও, অ্যাজমায় অন্তত ভাল খবর)। বলছেন ডা. সালভি।
হাত পরিষ্কার, মাস্ক ব্যবহার
মাস্ক পরার ফলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অ্যাজমার কামড় অনেকটাই কমেছে। সামনে আসছে এই মহামূল্যবান পর্যবেক্ষণও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল হয়তো খুলে যাবে, কিন্তু মাস্কের ব্যবহার এখন চলতে থাকবে। এর ফলে আগামীতেও অ্যাজমার দাপট কম থাকবে বলেই মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকে। করোনা থেকে বাঁচতে বার বার হাত ধোওয়া অ্যাজমার সংখ্যা হ্রাসের একটি কারণ। ডা. সালভি বলছেন, হাত ধোয়ার যে অভ্যাস তৈরি হয়েছে, তা প্যানডেমিকের পরও বজায় থাকবে বলেই মনে হয়। অ্যাজমা রোধে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অ্যাজমার চিত্র
শিশুরা যে সব ক্রনিক অসুখে ভোগে, তার মধ্যে এক নম্বরে অ্যাজমা। এমনই জানাচ্ছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO)। তাদের হিসেবে, ২০১৯-এ ২ কোটি ৬২ লক্ষের অ্যাজমা হয়েছিল, মারা যায় ৪ লক্ষ ৬১ হাজার। গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ বা জিবিডি-র রিপোর্ট বলছে, ভারতে তিন কোটি ৪০ লক্ষ অ্যাজমা রোগী, এর ২৫ শতাংশ শিশু। সারা পৃথিবীতে অ্যাজমা রোগীদের ১১ শতাংশ ভারতের। আর বিশ্বের অ্যাজমায় মৃতদের মধ্যে এ দেশের ৪২ শতাংশ।
আরও পড়ুন করোনার ন্যাজাল ভ্যাকসিনে সাফল্য, কী ভাবে?
শিথিলতার পর
লকডাউন-শিথিলতায় শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের অসুখ বেড়েছে। এমনটাই পর্যবেক্ষণ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের। সিনিয়র পেডিয়াট্রিশিয়ান এবং পুণের কোভিড টাস্ক ফোর্সের সদস্য উমেশ বৈদ্য বলছেন, 'এই ধরনের অসুখ বাড়ে আবহাওয়া এবং ভাইরাল সংক্রমণের যুগলবন্দিতে। গত বছর যখন পুরোপুরি লকডাউন ছিল, তখন অ্যাজমা খুবই কম হতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শিথিলতার ফলে যখন শিশুরা নিজেদের মধ্যে খেলাধুলো-মেলামেশা শুরু করল, তখন থেকেই এই অসুখ সামান্য হারে বাড়তে শুরু করে। এই মাসেও আমরা ওই একই চিত্র দেখছি।'
শিশুরা, তাদের বাবা-মায়েরা হা-পিত্যেশ অপেক্ষায় কবে খুলবে স্কুল। স্কুল বন্ধে যেন জীবনের মূলমধ্যরেখাটাকে ধরেই টান মারা হয়েছে। তা ছাড়া, যে ভাবে অন্য সব কিছুতে 'লক', তাও পরিস্থিতির নাজেহাল-দশা আরও বাড়িয়েছে। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু… শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন এই গানটাই ধরেছে। তবে, গানটা একটু ভাল করেই গাইতে পারছে অনেকে, কারণ অ্যাজমা যে তলানিতে, শ্বাসের কষ্টে গলা বুজে যাচ্ছে না। লকডাউন ভালও, শিশুরা-গার্জেনরা অ্যাজমার বিচারে এটা মনে করে বিশাল যন্ত্রণায় একটু স্বস্তির প্রলেপ দিতে পারেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন