বহু ঝড় দেখেছে সুন্দরবন। কিন্ত আমফানের মতো ঝড় বহুকাল দেখে নি। গত ২১ মে আন্দাজ ১৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টার গতিতে সুন্দরবন সহ পশ্চিমবঙ্গের একাধিক এলাকায় আছড়ে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়, নজিরবিহীন তার ধ্বংসলীলা। গত বছরের নভেম্বর মাসে আরেক ঘূর্ণিঝড় বুলবুল উপড়ে দিয়ে যায় সুন্দরবনের প্রায় ৭৫ শতাংশ গাছপালা। তার অসম্পূর্ণ কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেল আমফান, এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
একের পর এক ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছে এই এলাকার ওপর দিয়ে, মূলত তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। বঙ্গোপসাগরের ওপর উদ্ভূত যে কোনও সামুদ্রিক ঝড় সুন্দরবনের মধ্য দিয়েই বয়ে যাবে, এটি স্বতঃসিদ্ধ। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বঙ্গোপসাগরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ঘূর্ণিঝড় উৎপাদনকারী নিম্নচাপের মাত্রা। গত বছরের গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। নভেম্বরে আসে বুলবুল। এবছর আমফানের পালা। এদের অন্তর্বর্তী সময়ে বেশ কিছু ঘূর্ণিঝড় দিশা বদলে সুন্দরবনকে কিছুটা হলেও রেহাই দেয়।
সুন্দরবনকে বাঁচানো কেন জরুরি?
প্রথম কথা, সুন্দরবন স্রেফ সুন্দরি গাছের নামাঙ্কিত ম্যানগ্রোভের জঙ্গল নয়, ১৯৮৭ সাল থেকে সুন্দরবন একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সুন্দরবন বৃহত্তর বাংলার রক্ষাকবচও বটে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে দুই বাংলাকেই রক্ষা করে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ আবরণ, বা বলা ভালো বর্ম। তাছাড়া রয়েছে জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস, এবং লবণাক্ত জলের ধারা, যা ম্যানগ্রোভের জঙ্গল না থাকলে ঢুকে পড়ত আমাদের নদী-খাল-বিলে। এছাড়াও সুন্দরবনের হাজার হাজার খাঁড়িতে নানা প্রজাতির মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন অসংখ্য মৎস্যজীবী (ভারতীয় সুন্দরবনের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ), যাঁদের বাস এই অঞ্চলের ছোটবড় নানান দ্বীপে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবন রক্ষায় ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ রোপণের পরিকল্পনা সরকারের
আমফানের তীব্রতায় ভেঙে গিয়েছে বহু নদীবাঁধ। যার ফলে জনবসতির মধ্যে প্রবেশ করেছে লবণাক্ত জল। এই পরিস্থিতিতে মানুষের বসবাস সম্ভব নয়। তাছাড়াও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে অগুনতি বাড়ি, বিশেষ করে কাকদ্বীপ, হিঙ্গলগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, নামখানার মতো এলাকায়। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও তো সম্ভব নয়, সুতরাং সুন্দরবনকে ফের বাঁচিয়ে তোলা ছাড়া গতি কী?
সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণভূমি শুধু নয়, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চগুলির মধ্যে অন্যতম এই এলাকায় সহবাস করে আরও অসংখ্য প্রাণী, সঙ্গে অজস্র প্রজাতির গাছ। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, এবং মেঘনা নদীর ত্র্যহস্পর্শে গড়ে ওঠা এই ব-দ্বীপ (ডেল্টা) ভারতের বৃহত্তম সংরক্ষিত জলাভূমিও বটে। মোট ব্যাপ্তি প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিমি, ভারতের ভাগে পড়েছে ২,১১৪ বর্গ কিমি। দেশে যত ম্যানগ্রোভ আবরণ রয়েছে, তার ৪৩ শতাংশই সুন্দরবনে। প্রায় ১০০ টি বাঘ ছাড়াও এখানে বিচরণ করে কুমির, কাছিম, শুশুক, এবং নানাবিধ পরিযায়ী পাখি।
ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ দ্বারা প্রকাশিত ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, গত ১০০ বছরে সারা বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠ (সি লেভেল) বেড়েছে ১৯ সেন্টিমিটার, এবং বর্তমানে বৃদ্ধির হার প্রতি বছরে ৩.৬ মিলিমিটার। এই শতাব্দীর শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ ৩০-৬০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা। নদী বিশেষজ্ঞ তথা পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "অন্যান্য সুমদ্র বা মহাসাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরে এই বৃদ্ধি বিপজ্জনক রকমের বেশি। এছাড়াও বাংলার উপকূলবর্তী এলাকাগুলি ক্রমশ নিঃশেষিত হয়ে পড়ছে, যা পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।"
সুতরাং সুন্দরবন না বাঁচলে যে বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশও বাঁচবে না, সে সম্পর্কে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকলে তা শক্তিশালী দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে, ঘন জঙ্গলে আবদ্ধ হয়ে কমে যাবে হাওয়ার তীব্রতা। হ্যাঁ, সেই ধাক্কা সামলাতে গিয়ে জখম হবে অনেক গাছ, কিন্তু তাদের জায়গা নেবে নতুন গাছও। সতত পরিবর্তনশীল এই অঞ্চলের ভূমি-গঠন এটা নিশ্চিত করে যে, পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ফের গজিয়ে উঠবে ম্যানগ্রোভ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন