গুগলে 'মানকড়' বা 'মানকড়িং' লিখে সার্চ দিলে দেখবেন, গত দিনকয়েক ধরে হাজার হাজার হিটস। রাতারাতি বিস্মৃতি থেকে প্রবলভাবে ফিরে এসেছেন ভিনু মানকড়। ফিরে এসেছে ১৯৪৭-এ ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের ফ্ল্যাশব্যাক, যখন বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যান বিল ব্রাউন বারবার বল করার আগেই নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে বোলার মানকড় বল না করে বেল তুলে নিয়েছিলেন উইকেটের। বাহাত্তর বছর আগের সেই ঘটনা ফের এখন চর্চায়। সৌজন্য, রবিচন্দ্রন অশ্বিন। যিনি গত সোমবার চলতি আইপিএল-এর রাজস্থান রয়্যালস বনাম কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের ম্যাচে 'মানকড়িং' পদ্ধতিতে জস বাটলারকে আউট করে আপাতত ক্রিকেটদুনিয়ায় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।
অশ্বিন বিতর্কে প্রায় আড়াআড়ি ভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছে ক্রিকেট জগৎ। শেন ওয়ার্নের মতো কেউ কেউ যেমন অশ্বিনকে তুলোধোনা করেছেন বাছাবাছা বিশেষণে, প্রশ্ন তুলেছেন 'ক্রিকেটীয় স্পিরিট'-এর অভাব নিয়ে, তেমন কপিলদেবের মতো কারও কারও সমর্থনও পেয়েছেন অশ্বিন, 'আইনের বাইরে তো কিছু করেনি' যুক্তিতে। মোদ্দা কথাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই, আইন আগে, না স্পিরিট আগে?
আরও পড়ুন: ‘মানকড়িং! বাটলারের বিতর্কিত আউট নিয়ে সমালোচিত অশ্বিন
আগে আইনের কথা। ক্রিকেট আইনের ৪১.১৬ ধারা বলছে, বোলার বল 'রিলিজ' করার মুহূর্তের আগে যদি নন-স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান, বোলার রান আউট করতে পারেন ব্যাটসম্যানকে। রান আউটের এই চেষ্টায় বোলার সফল হন বা না হন, বলটি ওভারের ছ'টি বলের একটি বলে গণ্য হবে না।
"My actions were within cricket's rules, can't be called unsporting."
- @ashwinravi99 responds to accusations of him unfairly running out @josbuttler. #RRvKXIP #VIVOIPL pic.twitter.com/ygOmyGTzCL— IndianPremierLeague (@IPL) March 25, 2019
সুতরাং, অশ্বিন যা করেছেন, যেভাবে আউট করেছেন বাটলারকে, সেটা ক্রিকেটীয় বিচারে সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ। এমসিসি কী বলছে? প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, অশ্বিন বেআইনি কিছু করেননি। তার আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে হঠাৎ অবস্থান আমূল পাল্টে ফেলে শেষতম প্রতিক্রিয়া, ভিডিও বারবার খুঁটিয়ে দেখে মনে হচ্ছে, অশ্বিনকে পুরোপুরি 'ক্লিন চিট' দেওয়া যায় না। তা প্রথমেই ভিডিওটা খুঁটিয়ে দেখতে কে বারণ করেছিল এমসিসি-র কর্তাদের? বোধোদয় হতে দেরি হল কেন? উত্তর নেই, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে পাওয়ার সম্ভাবনাও শূন্য।
এবার 'স্পিরিটে' আসি? বলা হচ্ছে, অশ্বিনের আচরণ ক্রিকেটীয় স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের পরিপন্থী। কোন 'স্পিরিট'? সেই স্পিরিট, যা অনুসরণ করতে গিয়ে ১৯৮৭-র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ বিপক্ষের পাক ব্যাটসম্যান সেলিম জাফরকে 'মানকড়িং' করার সুযোগ পেয়েও করেননি, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা হেরে যাওয়া সত্ত্বেও ক্রিকেটবিশ্ব ধন্যধন্য করেছিল? নাকি সেই স্পিরিট, ১৯৮০-র ভারত-ইংল্যান্ড জুবিলি টেস্টে যা দেখিয়েছিলেন ভারতের অধিনায়ক বিশ্বনাথ, আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আউট হওয়া বব টেলরকে ক্রিজে ফিরিয়ে এনে?
আরও পড়ুন: কলকাতার রাস্তায় হাঁটেন? প্রাণ হাতে থাকে তো?
মুশকিল হল, সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সে সব দিন গেছে, একেবারেই গেছে। রাতের কোনও তারাই আর দিনের আলোর গভীরে লুকিয়ে নেই। শুনতে সে যতই কানে লাগুক, পড়তে সে যতই খারাপ লাগুক, সত্যিটা হল, একুশ শতকের ক্রিকেট আর 'জেন্টলম্যানস গেম' নেই। কিসের ভদ্রলোকের খেলা ভাই, যখন ম্যাচফিক্সিং-এর উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে ছড়িয়ে আছে ভুরিভুরি? কিসের স্পিরিট ভাই, যখন টেস্ট ম্যাচে পকেটে লুকোনো স্যান্ডপেপার দিয়ে বল বিকৃতির দায়ে নির্বাসিত হন বিশ্বক্রিকেটের দুই অস্ট্রেলীয় মহারথী?
উদাহরণ অজস্র দেওয়া যায়। সার কথাটা হল, আধুনিক ক্রীড়াজগতে 'স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' একটি বায়বীয় বস্তু। মুষ্টিমেয় কেউ কেউ কখনও দেখিয়ে ফেলেন, কিন্তু সেটা নিয়ম নয়। নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র। আজকের মারমার-কাটকাট জগতে গরিষ্ঠ অংশ জিততে চায়। এবং যে কোন মূল্যে। জেতাটা আজকের পেশাদার ক্রীড়াবিদের কাছে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার নয়। বরং একমাত্র জরুরি ব্যাপার। অভীষ্টে পৌঁছনোর জন্য চুরিবিদ্যাও মহাবিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা! বল ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটকিপারের কাছে গেছে জেনেও অনেকে তবু দাঁড়িয়ে থাকেন ক্রিজে, দ্বারস্থ হন ডিআরএস-এর। তেমন ক্যাচ ধরার আগে বল মাটি ছুঁয়েছে জেনেও হইহই করে অ্যাপিল করে ফিল্ডার সহ গোটা টিম। স্পিরিট? সেটা খায়, না মাথায় দেয়? ওই যে, 'যদি না পড়ো ধরা' সিনড্রোম।
Law is above The Mythical Spirit of The Game. Don’t fret. Don’t frown. #Ashwin #Buttler #RRvKXIP #IPL
— Aakash Chopra (@cricketaakash) March 25, 2019
অশ্বিন এইসব কিচ্ছু করেন নি। চুরি করেন নি। ম্যাচ ফিক্সিং করেন নি। বলের বিকৃতি ঘটান নি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যানকে আইন মেনে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছেন।
অনেকে বলছেন, আউট করার আগে অন্তত একবার সতর্ক করা উচিত ছিল বাটলারকে। আইনে কোথাও লেখা নেই এই সতর্কবার্তার কথা। তাহলে এত গেল-গেল রব কেন?
আর তা ছাড়া বাটলার কি ক্রিকেটীয় স্পিরিটের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন নাকি? আইন ভেঙে বোলারের বল রিলিজের আগেই বারবার ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটা অনৈতিক সুবিধে নেওয়া নয়, ক্রিকেটীয় স্পিরিটকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো নয়? স্পিরিট রক্ষার পবিত্র দায় শুধু বোলারেরই বুঝি, ব্যাটসম্যানের নয়?
অশ্বিন আইন ভাঙেন নি। স্পিরিটেরও দফারফা করেন নি এমন, যে বিচারসভা বসিয়ে দিতে হবে। লিখেই ফেলি স্পষ্ট, যা করেছেন, বেশ করেছেন।