Advertisment

বাংলা বানান দেখে রেগে যাবেন না

বানান বদলের ব্যাপারে একটা যুক্তি নতুন করে উঠে আসছে, সারল্যের স্বার্থে, উচ্চারণ অনুসারে বানান লেখা। এ তরফের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি, এতে বানান আর ভুল হবে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Bangla Spelling, International Language Day

বাংলা ভাষায় বানান ভুলের বহর বাড়ছে (অলংকরণ- অভিজিত বিশ্বাস)

বাংলা বানান নিয়ে প্রতিদিন রেগে ওঠার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, যদি ভেবে দেখা যায়, এর একটা রসাত্মক দিক রয়েছে। শুধু গ্রহণ ক্ষমতা দরকার। রস মানে আক্ষরিকও। বাংলা বানান রসালো, ফলে তার একটা অন্তর্বস্তুগত নরম ভাব রয়েছে। ফলে তা বদলে বদলে যায়। এক এক প্রকাশনায় এক এক রকম, এক এক সংস্করণে এক এক রকম, লেখক ভেদে এক একরকম, এমনকী দলভেদেও, সম্ভবত। আবার রসাত্মক হবার কারণে, তা বিভিন্ন সময়ে নব না হলেও, বেশ কিছু রসের উদয় পাঠকের মনোমধ্যে হয়ে থাকে।

Advertisment

যেমন ধরুন 'ইতিমধ্যে' শব্দটা। ছেলেবেলা থেকে পড়ে এলাম ব্যাকরণ বইয়ে, 'ইতিমধ্যে' ঠিক, 'ইতোমধ্যে' ভুল, অথচ গণশক্তি পত্রিকা ও তার অনুসরণকারীরা দিব্যি লিখে চলেছেন ইতোমধ্যে। কী জানি, ব্যাকরণ বইটাই বদলে গিয়েছে কিনা।

বাংলা বানানের যেহেতু কোনও নির্দিষ্টতা নেই, ফলে কোনও স্পেলচেকারও নেই। ফলে গোটা ব্যাপারটাই ইংরেজিতে যাকে বলে গো অ্যাজ ইউ লাইকের মত। (গো অ্যাজ ইউ লাইকের চালু বাংলা যেমন খুশি সাজো, এ ক্ষেত্রে খাটবে না।) এবং স্পেল চেকার নেই বলে বাংলা বানানের নির্দিষ্টতা নেই। কয়েকটা চালু নিয়ম রয়েছে, কিন্তু সে নিয়মও আজকাল কেউ মানার তেমন চেষ্টা করছেন না।

বাংলা ভাষা ও ভাবনায় ইংরেজি আধিপত্য

স্টাইলশিট বলে একটা ব্যাপার কোনও কোনও প্রকাশনা সংস্থা বা সংবাদমাধ্যমের দফতরে থেকে যায় হয়ত, কিন্তু সেও খাতায় কলমে। কেউ সে সব খুলেও দেখে না, প্রয়োজনবোধহীন বলে মনে করেই। এ ধরনের বোধ(হীনতা) আসলে কিছুটা উপর থেকে ন্যস্ত হয়।

বাংলা ভাষার তেমন বাজার নেই। এবং বাংলা ভাষার এক ধরনের অবিন্যস্ততার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু সে সব তত্ত্বকথা। আমাদের এখনকার জোর বাংলা বানান নিয়ে।

একটি বিশিষ্ট প্রকাশনা সংস্থার গেল পুজো সংখ্যার উপন্যাস খুলে দেখুন, নির্ভুলভাবে প্রতি ক্ষেত্রে ইংরেজি z উচ্চারণ যেখানে হবে, সেখানে জ় লেখা রয়েছে, কিন্তু সেই লেখাতেই পাওয়া যাবে বানান ভুল, যাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে 'মুদ্রণপ্রমাদ' বলে ডাকা হয়ে থাকে। মুদ্রণপ্রমাদ খুব চমৎকার শব্দ ছিল, যখন সব লেখালিখিই হত ছাপায়। হাতের লেখায় সেগুলিকে 'বানান ভুল' বলে চিহ্নিত করা হয়।

কিন্তু দিন বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখার প্রকাশ আর ছাপাখানায় সীমাবদ্ধ নেই, ফলে মুদ্রণপ্রমাদ শব্দ দিয়ে পুরো ব্যাখ্যাও করা যাবে না। এবার নতুন শব্দ এল, 'টাইপো'। টাইপ করতে গিয়ে ভুল হয়ে গেলে, তাকে বলা হতে থাকে টাইপো। ফেসবুকে, পোর্টালে বিভিন্ন বানান প্রমাদের এখন এটিই নবতম এবং স্বীকৃত যুক্তি।

আমাদের নীতি আছে, নৈতিকতা নেই: গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার

যুক্তির অবশ্য এখানেই শেষ নয়। আরেক যুক্তি বদলে যাওয়া বানান। বাংলা ভাষাবিদরা, বানানকে সহজতর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন বদলের প্রস্তাব এনেছেন, যা বাংলা অকাদেমি মেনেও নিয়েছে। কিন্তু অকাদেমি মেনে নিলেও দৈনন্দিন ব্যবহারকারীদের তেমন মানবার দায় নেই। ফলে দায় নেই জানারও। 'নদীয়া' বানান যদি পাল্টে গিয়ে 'নদিয়া' হয়ে থাকে, তাহলে তা মানার দায় সকলের উপর বর্তাচ্ছে না।  'আচার্য্য' না 'আচার্য', কোনটি বর্তমান স্বীকৃত বানান, তা জেনে নেওয়ার বা জানিয়ে দেবার কোনও বাধ্যবাধ্যকতা কারও হাতে নেই। বাংলা শব্দ বা তদ্ভব শব্দ ও তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে নিয়মাবলী যে আলাদা, বাংলা বানানের ক্ষেত্রে, তা একদা ইশকুলে শেখানো হত, কিন্তু এখন মাস্টারমশাই দিদিমনিদের সোশাল মিডিয়ার বাংলা বানান আঁতকে ওঠবার মত।

পাল্টে যাওয়া বানান, ফলে প্রমাদ ঘটানোদের একটা আবডাল হয়ে দেখা যায়। এরকম অভিজ্ঞতাও পাওয়া যাবে, যেখানে পর্যবেক্ষণ বানানে ন লেখার পর, প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে 'ও, এটা বদলায়নি!'

অর্থাৎ, বদলের কারণ সম্পর্কে এঁরা কেউ ওয়াকিফহাল নন, বদলের যুক্তি তো দূরের কথা।

অনেকেই বলেন, বাংলা বানান থেকে ঊ, ঈ তুলে দিলে প্রমাদের পরিমাণ কমবে। হয়ত কমবে। কিন্তু দেওয়ালে দেওয়ালে দুর্নীতিকে 'দূর্নীতি' দেখে অভ্যস্ত চোখ অত সহজে বদলাবে কি? অভ্যাসে?

দেওয়াল লেখার কথা যখন এসেই পড়ল, তখন কথাটা নিয়ে আরেকটু বিশদে যাওয়া যাক। দেওয়াল লেখা, পোস্টার, এখন ফ্লেক্স হয়েছে আবার, এসবে বাঙালি চোখ ছেলেবেলা থেকে অভ্যস্ত। ভাষা মানুষ চোখে দেখেও তো শেখে।

ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ

যাঁরা পোস্টার-দেওয়াল লেখেন, ফ্লেক্স বানান, তাঁদের অবশ্য এ দিকটা মাথায় থাকে না। তাঁরা কেমন নিজেদের কাজটুকু সেরে ফেলতে পারলেই হাত (ব্রাশ) ধুয়ে ফেলেন। ফলে তাঁরা ভুল বানান লেখেন কিনা, লিখছেন কিনা, তা নিয়ে খুব জোরদার চর্চার মধ্যে থাকেন না। তাঁরা মনেও করেন, বিষয় হল আসল। কিন্তু মুশকিল হল, কেউ যদি 'অনসূয়া' বানান 'অনুসুয়া' লেখেন, বা আগে যেমন বলা হল, 'দূর্নীতি' লেখেন, তাহলে তাঁদের থেকেও লোকে শেখে। ভুল শেখে। সম্ভবত, তাঁরা একথা মনেও করেন না, যে তাঁদের কাছ থেকে কেউ কিছু শিখতে পারে, কিন্তু তাঁদের বুঝতে হবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে তাঁদের কাছ থেকেও লোকে শেখে, বিশেষত অল্পবয়সীরা।

বানান বদলের ব্যাপারে একটা যুক্তি নতুন করে উঠে আসছে, সারল্যের স্বার্থে, উচ্চারণ অনুসারে বানান লেখা। এ তরফের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি, এতে বানান আর ভুল হবে না।

যদিও তর্কক্ষেত্রে এঁরা মেনে নেবেন যে, বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশে মুখের ভাষা ও লেখার ভাষা আলাদা হয়েছে, তবু তাঁরা 'কেন'-কে 'ক্যানো' লেখারই পক্ষপাতী।

লেখার ভাষা আর কথ্য ভাষার মধ্যেকার ব্যবধান অবশ্য সোশাল মিডিয়ার সৌজন্যে ক্রমশ ঘুচে যাচ্ছে। বাংলায় অভ্রর আবিষ্কার ও স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতার সুবাদে সকলেই এখন অন্তত ফেসবুকে বাংলা লিখছেন। এবং তাঁরা যা ভাবছেন, ঝট করে তখনই তা লিখে ফেলছেন, যা মনে আসছে, তাই লিখছেন। মনের কথা বহু সময়েই কথ্য ভাষাতেই আসে, ফলে এমনকি তাপস পালের মৃত্যু হোক বা শঙ্খ ঘোষের অসুস্থতা, প্রায় সকলেই দ্রুত লিখে ফেলার তাগিদে মনের কথ্য ভাষাকে লিখ্য ভাষায় রূপান্তরিত করার হয় সময় পাচ্ছেন না, বা প্রয়োজনীয়তাই মনে করছেন না। ফলে বিনা দ্বিধায় 'ওঁর' জায়গায় লেখা হচ্ছে 'ওনার'।

এর সঙ্গে সোশাল মিডিয়া, বিশেষত ফেসবুক দুই বাংলার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চালু, এ বাংলায় দেখতে অনভ্যস্ত বিভিন্ন বানানও ঢুকে পড়ছে। 'ওনার' যেমন একটা উদাহরণ, তেমন আরেকটা উদাহরণ 'চাচ্ছিলাম'। কথাটা, আমরা বাংলায় দেখতে অভ্যস্ত চাইছিলাম। কিন্তু ওপার বাংলায় চাচ্ছিলাম একটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যদিও মনে রাখতে হবে, জীবনানন্দ দাশ তাঁর উপন্যাসে অনেক আশ্চর্য ব্যবহারের মত, 'চাচ্ছিলাম' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

ভাষা দিবসে ফিরে দেখা; কেমন আছে বাংলা অভিধান?

বা ধরা যাক এল। এল শব্দটাই এ বাংলায় লিখিত ভাষায় প্রচলিত। আসলো একেবারেই কথ্য। কিন্তু মুখের ভাষাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে আকারে লিখে ফেলার প্রবণতা থেকে বাংলা ভাষায়, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষায় এল বা এলো-র জায়গায় আসল বা আসলো লেখার একটা তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে, এমনকি সাহিত্যেও। সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস বা গল্পের বইয়েও এই ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। তার একটা বড় কারণ হল, যিনি লিখছেন, বা যিনি প্রুফ দেখছেন, (বাংলা প্রকাশনায় সম্পাদনার ব্যাপার প্রায় বিরল) কারোরই এ ব্যাপারটা খেয়াল হচ্ছে না।

আর্ষ প্রয়োগ ও অজ্ঞানতাবিষয়ক প্রয়োগ বহু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় মিলে মিশে যাচ্ছে। শত ফুল ও শত আগাছা সমান তালে বিকশিত হচ্ছে, বাংলা বানানে। বা, আগাছার পরিমাণই বেশি হয়ত।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Language Day
Advertisment