Advertisment

করোনা যুদ্ধে বিস্মৃত যাঁরা, সেই অভুক্তদের একমাত্র ভরসা পুলিশের ভ্যান

মধ্যমগ্রাম এলাকার দোলতলা মোড় থেকে দৈনিক যাত্রা শুরু করে এই বিশেষ ভ্যান, এবং ক্রমশ এগোতে থাকে বারাসাতের কাছারি মাঠের দিকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
west bengal police

এঁদের জন্যই রোজকার প্রতীক্ষা। ছবি: শশী ঘোষ

মুখোশের মধ্যে দিয়েই দেখা যায় হাসিগুলো। কুঁচকে যায় চোখের আশেপাশের বলিরেখা। ওই আসছে পুলিশের সবুজ ভ্যান, তার দিকে তাকিয়ে কোলে বাচ্চা সমেত মহিলা, বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আসা বৃদ্ধ, এমনই আরও কত মানুষ। ঘটনাস্থল - বারাসাত রেলস্টেশনের কাছে কাছারি মাঠ, উপলক্ষ্য - প্রাত্যহিক মধ্যাহ্নভোজন।

Advertisment

দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের ফলে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভারতের দিনমজুর এবং গৃহহারা গোষ্ঠীর মানুষ। আয়ের পথ মোটের উপর বন্ধ, সুতরাং পেটের ভাত জোটানো ক্রমশই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কিন্তু কলকাতার কাছেই এই এলাকায় স্থানীয় পুলিশের কল্যাণে দুর্দশাগ্রস্ত এই মানুষগুলোর অন্তত একবেলা পেট পুরে খাবার জুটছে।

লোকাল ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে স্টেশন প্ল্যাটফর্ম এবং লাইনের ধারে ধারে বসবাসকারী, বা ট্রেনের আসা যাওয়ার উপর সরাসরি নির্ভরশীল মানুষদের জীবন। প্রথম প্রথম তাঁদের হাতে রেশন এবং জরুরি পণ্য তুলে দিচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, কিন্তু তাতে সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। তা বুঝতে পেরেই আরও একধাপ এগিয়ে এলো তারা, সিদ্ধান্ত নিল ১০০ জনকে একবেলা রান্না করা খাবার দেওয়ার। একমাসের বেশি হয়ে গেল, এই লক্ষ্যে অনড় থেকেছেন বারাসাত জেলা পুলিশের কর্মীরা।

আরও পড়ুন: ‘এত আলোচনা হয় টিভিতে, ডাক্তারদের ডাকা হয়, নার্সদের হয় না কেন?’

মিনি মণ্ডল (২৮), ১১ মাসের এক সন্তানের মা। বলছেন, "বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমার স্বামী রিক্সা চালাত, কিন্তু এখন রোজগার বন্ধ। ভেবেছিলাম না খেয়ে মরতে হবে। কিন্তু ওই পুলিশ বাবু এসে আমাদের কিছু চাল, আলু, আর সাবান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমরা ঠিক আছি কিনা। কিছুদিন পর বললেন আমাদের জন্য রান্নাও করে দেবেন।" একদিনের জ্বালানি বাঁচলেও যে পরিবারের কতটা সাশ্রয় হয়, সেকথাও জানাতে ভোলেন না মিনি।

যেভাবে সারি বেঁধে রোজ অপেক্ষা করেন এঁরা সকলে, তা শিক্ষণীয়। প্রত্যেকে প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন, যদিও 'সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং' নামক শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত নন কেউই। ঠেলাঠেলি নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই, সবাই শান্তভাবে বসে। মাটিতে বসেও পরেরজনের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় থাকে। অপেক্ষা সেই একবেলা খাবারের, যার বেশি এঁদের অনেকেরই হয়তো এখনও জুটছে না।

west bengal police লকডাউনের শুরু থেকেই প্রায় ১০০ মানুষকে দৈনিক একবেলা খাওয়াচ্ছে বারাসাত জেলা পুলিশ। ছবি: শশী ঘোষ

নিজের পাতে একটা গোটা ডিম, এবং গোটাটাই তার জন্য, এমনটা দেখতে অভ্যস্ত নয় ১১ বছরের তনিমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে কিনা। গরম ভাত এবং ডিমের ঝোল পরিবেশনকারী পুলিশকর্মী বলেন, "কী হলো, খাও, পুরোটাই তোমার।" তনিমার আনন্দ আর ধরে না। ডিমের ঝোল বলতে সে বোঝে মায়ের রাঁধা ডিমের অমলেটের ঝোল, যাতে তার পুরো পরিবার ভাগ পেতে পারে।

অনেকের কাছেই যা নিতান্তই সাদামাটা খাবার, ৭০ বছরের পূর্ণিমা দেবীর কাছে তাই রাজভোগের সামিল। "স্টেশনে খাবারের দোকানের ওরা যা দেয়, তাই খেয়েই অভ্যেস - রুটি তরকারির বেশি কিছু নয়। কিন্তু পুলিশ দিদি চারটে পদ খাওয়ালেন... ডাল-ভাত হলেই তো আমি খুশি," চোখের জল মুছে পরিবেশনে রত এক পুলিশকর্মীর দিকে ইশারা করে বলেন বৃদ্ধা। শুধু ডাল নয়, সঙ্গে শুক্তো এবং ডিমের ঝোল, এবং সকলের পাতেই যথেষ্ট পরিমাণে।

west bengal police নিয়ম মেনে শান্তভাবেই অপেক্ষা করেন সকলে। ছবি: শশী ঘোষ

ফোনালাপে বারাসাত জেলা পুলিশের সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "এই চরম সঙ্কটের সময় গরীব মানুষের বিশেষভাবে প্রয়োজন একটু সাহায্যের। আমরা চাই নি সকলে ভিড় জমান, তাই ভাবলাম যে নিজেরাই এখন থেকে ওখানে গিয়ে খাবার দিয়ে আসি। আমাদেরই একটি বিল্ডিংয়ে রান্না করেন আমাদের কিছু কর্মী, তারপর মেইন রোড ধরে চলতে থাকি আমরা, রাস্তায় কাউকে দেখলে খেতে দিই।"

খাবার রান্না এবং পরিবেশন, উভয় ক্ষেত্রেই সযত্নে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়। মধ্যমগ্রাম এলাকার দোলতলা মোড় থেকে দৈনিক যাত্রা শুরু করে এই বিশেষ ভ্যান, এবং ক্রমশ এগোতে থাকে বারাসাতের কাছারি মাঠের দিকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মোটামুটি ৫ কিমি দূরত্ব রোজ অতিক্রম করে এই ভ্যান। খাবারের পাশাপাশি দেওয়া হয় এক বোতল করে জল। প্রয়োজন মতো সাবান এবং মাস্কও বিতরণ করা হয়, সঙ্গে থাকে এগুলির বর্তমান প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যথাবিহিত প্রচার।

আরও পড়ুন: গুজরাট ও বাংলা: করোনা যুদ্ধে দুই রাজ্যে কেন লাল সতর্কতা

"সব দিন সমান যায় না, তবে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি আমরা। এমনও হয়েছে যে মাঠে পৌঁছনোর আগেই খাবার ফুরিয়ে গিয়েছে, কারণ পথে যেতে যেতে কিছু বেশি মানুষকে হয়তো খাওয়াতে হয়েছে। তবে আমরা নিশ্চিত করি যে কেউ যেন খালি পেটে ফেরত না যান, তাই একবার শেষ হয়ে গেলেও আমরা খাবার নিয়ে ফিরে আসি। খুব বেশি হয়তো কিছু করতে পারি না, কিন্তু দিনে যাতে অন্তত একবার এঁরা খেতে পান, সেটা নিশ্চিত করতে পারি," বলেন অভিজিৎবাবু।

west bengal police কোনো কোনোদিন গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই ফুরিয়ে যায় খাবার। ছবি: শশী ঘোষ

এই উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসছে পুলিশ ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে, এবং প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে অভুক্তদের সংখ্যা। ভ্যানের নিয়মিত যাত্রী কনস্টেবল অর্ণব রায়চৌধুরী বলছেন, "কেউ কেউ জানেন যে আমরা আসব, তাই শান্তভাবে আমাদের জন্য রোজ অপেক্ষা করেন। ছোট ছোট বাচ্চা, বুড়ো মানুষ... আমরা যদি শুকনো রেশন দিইও, এদের জন্য রান্না কে করবে? এখন অন্তত তাঁরা জানেন যে খালি পেটে থাকতে হবে না।"

প্রায় ৮৫ বছর বয়সী সুখেন বসু আজ কয়েক যুগ ধরে লাইনের ধারে বসবাস করছেন। এর আগে এলাকায় ভিক্ষে করে দিন চলত। বৃদ্ধ বলছেন, "দোকান বন্ধ হয়ে গেল, আমার রোজগারও বন্ধ। ভেবেছিলাম না খেয়েই মরতে হবে। পুলিশ দেখে ভাবলাম তাড়িয়ে দিতে আসছে বোধহয়, কিন্তু উল্টে খাবার দিল, আর খাওয়ার আগে হাত পরিষ্কার করার জন্য জলের মতো কী একটা। আমাদের কথা ভুলে যায় নি, ভেবে ভালো লাগে।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment