রাসবিহারী বসু। প্রায় বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন তিনি। দেরাদুনে কর্মরত ছিলেন, ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে। তাঁর কর্মকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। স্বাধীনতা দিবসে তাঁর ইতিহাসের দিকে একবার ফিরে তাকানো যাক।
হিমালয়ে ঘেরা দেরাদুন উপত্যকা সর্বদাই ব্রিটিশদের পক্ষে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে থেকেছে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়ে মিরাট ও দিল্লির অতি সংলগ্ন দেরাদুন ও নিকটবর্তী আরেক হিল স্টেশন মুসৌরি ঠান্ডাই থেকেছে। বহু ব্রিটিশ পরিবার পাশের জেলাগুলো, যেখানে অশান্তি হচ্ছিল, সেখান থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এখানে। এই শান্তির আবহে উদ্বুদ্ধ হয়েই ব্রিটিশরা দুন উপত্যকাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহর বানিয়ে তুলেছিল। সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি, বর্তমান আরআইএমসি এবং নাভাল হাইড্রোগ্রাফিক অফিসও তৈরি হয়েছিল সেখানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে তরুণদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছিল, কারণ তাঁরা চাইছিলেন পশ্চিমের বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাকে গ্রহণ করতে। কিন্তু একই সঙ্গে মাথাচাড়া দিচ্ছিল শৃঙ্খলিত ভারতকে মুক্ত করার স্বপ্ন।
আরও পড়ুন, ১৫ অগাস্ট দিনটিতেই কেন পালিত হয় ভারতের স্বাধীনতা দিবস?
এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন রাসবিহারী বসু, যাঁর জীবন ভারতের যুবসমাজের কাছে উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারে। বাংলার সুবলদহ গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। ছোট থেকেই শিখেছিলেন লাঠি খেলা। অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে বীজ রোপিত হয়েছিল, বিদ্রোহের বীজ। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় জড়িয়ে পড়ার পর বাংলা ছাড়েন তিনি। অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে, তবে তার চেয়েও বেশি ছিল তাঁর ক্ষমতা। তার জোরেই দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে হেড ক্লার্ক হিসেবে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলেন। পল্টন বাজারের কাচে ঘোসি গলিতে থাকতেন তিনি। ঘিঞ্জি ঘোসি গলির নাম এরকম হওয়ার কারণ সম্ভবত বেশ কিছু বাঙালি এখানে থাকতেন। দেরাদুনে থাকাকালীন রাসবিহারী বোসের সঙ্গে যোগাযোগ হল যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁরই হাত ধরে বাঘা যতীনের নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়লেন রাসবিহারী। যোগাযোগ হল আর্য সমাজের বিপ্লবী সদস্যদের সঙ্গে, যাঁদের কাজের জায়গা ছিল বর্তমান উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব। এমনকি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে কাজ করাকালীন রাসবিহারী বসুর মাথায় ঘুরে বেড়াত বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনাই।
১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হচ্ছে দিল্লিতে। দিল্লি প্রস্তুত তৎকালীন ভাইসরয় সর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর জন্য। চাঁদনি চকের এক বাড়িতে এক রোগা চেহারার মহিলাকে দেখা গেল ভাইসরয়কে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। বসন্ত বিশ্বাস নামে ১৬ বছররের এক কিশোর মহিলার ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে দেশি বোমা ছুড়ে দিয়েছিল হাতিতে বসা ভাইসরয়ের দিকে। হার্ডিঞ্জ বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু জখম এড়াতে পারেননি। এই হামলার পরিকল্পনা ছিল রাসবিহারী বসুর। বোমা তৈরিতে সাহায্যও করেছিলেন তিনিই। বিস্ফোরণের পরদিনই দেরাদুনে ফিরে আসেন রাসবিহারী এবং নিজের কাজের জায়গায় স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকেন। এমনকি কয়েক মাস পর হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন তিনি।
কিন্তু রাসবিহারী বসুর দিকে আঙুল উঠতে শুরু করে এবং সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়। উত্তর ভারতে তিন বছর ধরে চলে বিড়াল-ইঁদুর খেলা। কেউ কেউ বলেন, যখন তাঁর মাথার দাম এক লক্ষ টাকা, সে সময়ে পুলিশের চিফ কমিশনারের ঠিক উল্টো দিকে বসে ট্রেনে সফর করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে ভারত থেকে জাপানে পালিয়ে যান রাসবিহারী বসু।
আরও পড়ুন, ছত্তিসগড়ে মাওবাদীদের মোকাবিলা কীভাবে করছে নিরাপত্তা বাহিনী?
জাপানে বিভিন্ন এশিয় গ্রুপের ছত্রছায়া খুঁজে পেলেন রাসবিহারী। ১৯১৫ -১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বহুবার নিজের পরিচয় বদলান, বদলান বাসস্থানও। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর প্রত্যর্পণের ব্যাপারে জাপ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল। টোকিওর নাকামুরায়া বেকারির মালিকের বাড়িতে লুকেয়ে থাকার সময়ে তাঁর মেয়ে তোশিকো সোমাকে বিয়ে করেন তিনি। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম রাসবিহারী বোস সুভাষচন্দ্রকে এই ফৌজের কম্যান্ডার করার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে জাপানি নাগরিক হন তিনি, সেখানে বাস করতে থাকেন সাংবাদিক তথা লেখক হিসেবে। জাপানে ভারতীয় রান্নাকে জনপ্রিয় করার ব্যাপারেও তাঁর হাত ছিল। জাপানে সে সময়ে ব্রিটিশ রান্নার চল থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় রান্না জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময়ে রাসবিহারী নাকামুরায়ার বোস নামে পরিচিত ছিলেন।
গদর বিদ্রোহের অন্যতম মস্তিষ্ক রাসবিহারীর জীবন ছিল বর্ণময় এবং তিনি ছিলেন অকুতোভয়। তা সত্ত্বেও ভারতীয় ইতিহাল তাঁকে তেমন ভাবে মনে রাখেনি।
(লোকেশ ওহরি হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের নৃতত্ত্ব বিভাগে গবেষণারত।)