"এই এই..দাদা..দেখে দেখে..সামলে..," আতঙ্কে শব্দগুলো ছিটকে বেরিয়ে আসে আরোহীর মুখ থেকে।
যা দেখার, দেখেছেন, এবং যা সামলানোর, ততক্ষণে সামলেও নিয়েছেন উবের-চালক। কথা নেই বার্তা নেই, এক মাঝবয়সী পথচারী ব্র্যাবোর্ন রোডের মাঝবরাবর দুলকি চালে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন অফিস টাইমে। ট্র্যাফিকের সবুজ আলোর বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে। গাড়ি ছুটছে নিয়ম মেনে, সবুজ আলো লাল হবে মিনিটখানেক পরেই। নশ্বর পৃথিবীতে অত অপেক্ষা আর কে করবে, এই ভঙ্গিতে পথচারী ভদ্রলোক দিব্যি হাঁটা লাগিয়েছিলেন রাস্তা পারাপারে। অতঃপর ধাবমান গাড়ির সামনে পড়া অবধারিত, আরোহীর আঁতকে ওঠা, এবং পড়িমরি ব্রেক কষে চালকের শেষরক্ষা।
আরও পড়ুন: শিক্ষায় রাজনীতি নয়, চাই রাজনীতিতে শিক্ষা
'আরোহী' এই তুচ্ছ কলাম-লিখিয়ে। অফিস আসার পথে এই দিনতিনেক আগের সরেজমিন অভিজ্ঞতা। চোখের সামনে একটা নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে হল না, এই স্বস্তির শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই সম্বিৎ ফিরল চালকের তীব্র খেদোক্তিতে, "ক্লাচ.. ব্রেক.. ক্লাচ..পায়ে যা ব্যথা হয়..এভাবে আর পারা যায় না দিদি, জানেন? দেখলেন তো, এমনভাবে পেরোচ্ছে যেন বাপের রাস্তা! আর অ্যাকসিডেন্ট হলে যত দোষ ড্রাইভারের! আর পারা যায় না এভাবে।"
সহমত না হয়ে উপায় থাকে না। উপায় থাকে না চুপচাপ মেনে নেওয়া ছাড়া, "এভাবে আর পারা যায় না!"
পারা তো সত্যিই যাচ্ছে না। ঘটা করে বচ্ছরকার পথনিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করছে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ। রাস্তাঘাটে আইন মেনে পথচলার সচেতনতা বাড়াতে কত না কর্মকাণ্ড! কিন্তু যে শহরের পথচারীদের সিংহভাগ নিয়ম ভাঙাটাকেই 'নিয়ম' মনে করেন, সেখানে কী লাভ এসব করে? ভষ্মে ঘি ঢেলে কী লাভ আর, যখন 'আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান'-এর কাড়াকাড়ি শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা? চেতনা থাকলে তবে না সচেতনতা? বোধ থাকলে তবে না বুদ্ধি?
গড়িয়া থেকে গড়িয়াহাট, বৌবাজার থেকে যদুবাবুর বাজার, যে কোনও দিন এক চক্কর পথ-পরিক্রমাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আম নাগরিকের ট্র্যাফিক-সচেতনতার বহর।কোথাও কোনও তরুণ কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে 'আপনা টাইম আয়েগা' শুনতে শুনতে আয়েসে রাস্তা পেরোচ্ছে গাড়িস্রোতের মধ্যে দিয়ে। এভাবে চললে খুব তাড়াতাড়ি যে উপরে যাওয়ার 'টাইম আয়েগা', সেটা বিলকুল ভুলে গিয়ে। কোথাও বা একদল পথচারীর কাছে তিরিশ সেকেন্ডের অপেক্ষাও এক যুগের মনে হচ্ছে, হাত দিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছেন দল বেঁধে। কী তাড়া, কী তাড়া! যেন সিগন্যাল মেনে রাস্তা পেরোতে আধ মিনিট দেরি হলে আর অভিনন্দন বর্তমানের সঙ্গী হওয়া হবে না যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশপথে সমর-অভিযানে।
সব বেনিয়মেরই অজুহাত থাকে। যেমন ধরুন, "ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার উপায় রেখেছে হকাররা? ফুটপাথ তো হকারদের দখলে। 'নিয়ম মানুন' বললেই তো হল না, পরিবেশ কোথায় নিয়ম মানার?"
আরও পড়ুন: আরও আরও আরও যাক প্রাণ?
হ্যাঁ, শহরের অনেক ফুটপাথের সিংহভাগ হকারদের দখলে, মানছি। কিন্তু একটু ঘুরে দেখুন আমাদের সাধের কলকাতায়, দেখবেন, বহু রাস্তায় ফুটপাথ খালি থাকা সত্ত্বেও লোকে দিব্যি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। ওই যে শুরুতে লিখেছি, উবের-চালকের হয়রানি-হতাশা, "এমনভাবে চলছে যেন বাপের রাস্তা!"
বাপের রাস্তা হোক বা না হোক, একটা দুর্ঘটনা ঘটলে বাপ-ঠাকুর্দার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দেওয়ার মঞ্চ অবশ্য তৈরিই আছে। পথদুর্ঘটনায় কোনও মৃত্যু ঘটলে নন্দ ঘোষের ভূমিকায় কখনও ড্রাইভার, কখনও পুলিশ, কখনও প্রশাসন। পথচারীর কোনও দোষ নেই, কখনও থাকতে পারে না। পথচারী মানে তো 'সোনার কেল্লা'-র মুকুল, পূর্বজন্মের স্মৃতিচারণের মগ্নতায় যার মনেই নেই, লাল আলোয় রাস্তা পেরোনো, আর সবুজে থমকে দাঁড়ানো। আগে লিখেছি, আবার লিখি, নিয়ম ভাঙাই যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে 'নিয়ম' হয়ে দাঁড়ায়, তখন দিনের শেষে হাতে পেন্সিল তো দূরে থাক, রাবারও পড়ে থাকে না।
অবশ্য থাকবেই বা কী করে? নিয়ম ভাঙার কড়া মাশুল দিতে হলে তবেই না লোকে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর আগে দশবার ভাববে। যেখান-সেখান দিয়ে যখন খুশি, যেমন খুশি রাস্তা পেরোলে জরিমানার বিধান আছে আইনে। কত খেসারত? পঞ্চাশ টাকা। ঠিকই পড়লেন, মাত্র পঞ্চাশ! আজকের দিনে এটা কোনও অঙ্ক হল জরিমানার? এটাই যদি কমপক্ষে দুশো-তিনশোও হত, যদি টান পড়ত পকেটে, জেব্রা ক্রসিং দিয়ে নিয়ম মেনে সিগন্যাল অনুযায়ী রাস্তা পেরোনোর হিড়িক পড়ে যেত। 'কী আর হবে, পুলিশ কেস দিলে পঞ্চাশ টাকা খসবে, ও ঠিক আছে,' এই 'ডোন্ট কেয়ার' ভাবটা দ্রুত কেটে যেত পরপর তিনদিন দু'-তিনশো গ্যাঁটের কড়ি খরচ করতে হলে। কান টানলে তবে না মাথা আসবে! আইনের যা 'বজ্র আঁটুনির' ছিরি, কান টানা দূরস্থান, ধরাই তো যাচ্ছে না জুত করে।
বস্তুত, সে গাড়িই হোক বা পথচারী, রোজকার পথচলতি ট্র্যাফিক আইন ভাঙার শাস্তিবিধান এ দেশে এতই নরমসরম, এতই কম জরিমানার অঙ্ক, পাত্তাই দেয় না আমজনতার সংখ্যাগরিষ্ঠ। বছরখানেক আগে শোনা গিয়েছিল, আমূল সংশোধিত হবে সেন্ট্রাল মোটর ভেহিকলস আইন, ঢের বেশি কঠোরতর হবে আইন ভাঙার শাস্তি। সে আইন আজও দিনের আলো দেখল না। পরিণাম, যা হওয়ার তা-ই। রাস্তাঘাটে নিয়ম লাটে!
একসময় 'রাস্তাই রাস্তা দেখাবে' স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছিল এ বঙ্গে। তলিয়ে দেখলে, এ স্লোগান আজকের কলকাতাতেও অন্যভাবে প্রাসঙ্গিক।
রাস্তাই রাস্তা দেখাচ্ছে। সর্বনাশের।