Advertisment

লোকসভা নির্বাচন সংক্রান্ত কিছু বিষয়: দলবদল এবং ঘোড়া কেনাবেচা

কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়াটা অনেক স্বাভাবিক, কারণ একটি দল থেকেই অন্যদলের সৃষ্টি। তবে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বাম দলের প্রচুর নেতা কর্মীও দলবদল করেছেন, এবং এখনও তা চলছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Change of Political Parties

দলবদল ভারতীয় রাজনীতির এক অন্যতম অঙ্গ

লোকসভা নির্বাচন এসে গেল। আমরা চেষ্টা করছি “এই চিহ্নে ভোট দিন”-এর সামান্য বাইরে বেরিয়ে রাজনীতির বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে সামান্য আলোকপাত করতে। এই প্রসঙ্গে একবার ফিরে তাকানো যাক রাজনৈতিক পরিসরে দলবদলের রসায়নে। শুরুতেই একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে দলবদলের বিষয়টি রাজনীতির ক্ষেত্রে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিনা। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা সমর্থক হন মানুষই, এবং মানুষের নীতি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে দলবদল বা মতবদলের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজনৈতিক আদর্শের কথা ভেবে একদল থেকে অন্যদলে যাওয়া বা নতুন দল তৈরি করার বিষয়টি নিয়ে পরে আলোচনায় আসছি। তবে শুরুতেই বলে নেওয়া যাক আজকের দিনে সংসদীয় গণতন্ত্রে সর্বনাশের একটি প্রধান সূচক ঘোড়া কেনাবেচা। এখানে ঘোড়া বলতে ভোটে জেতা প্রার্থী বোঝানো হচ্ছে। অর্থাৎ এর আঙ্গিক হল নির্বাচনে এক দলের প্রার্থী হিসেবে জেতার পর সুযোগ সুবিধা মত অন্য দলে কেটে পড়া। সাধারণভাবে দলবদল পেশাদার রাজনৈতিক নেতাদের বৃত্তির একটা অংশ। রোনাল্ডো যে রিয়েল মাদ্রিদ থেকে জুভেন্টাস গেলেন এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। তবে নরেন্দ্র মোদী কংগ্রেসের বা রাহুল গান্ধী বিজেপির নেতা হয়ে গেলে চমক লাগবে অনেকটাই। মেনে নিতেই হবে যে নিজের দল ভেঙে নতুন দল গড়া বা একদল থেকে অন্যদলে চলে যাওয়া, এসব রাজনীতিতে থেকেই থাকে। কিন্তু তার মধ্যে ভোটে জেতার পরে দল ভেঙে প্রতিদ্বন্দ্বী দলে ঢুকে পড়া জনগণের প্রতি সরাসরি বিশ্বাসভঙ্গ। কারণ সেক্ষেত্রে আপনি যাদের সমর্থনে জিতলেন, চলে গেলেন তাদের বিরোধী দলে।

Advertisment

আরও পড়ুন, লোকসভা নির্বাচন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

এরকম দু-একটি রাজ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠ আসনে জিতে অন্যের দল ভাঙিয়ে কিংবা সমর্থন যোগাড় করে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। উদাহরণের মধ্যে অবশ্যই উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্য এবং গোয়ার কথা বলতে হবে। অরুণাচল প্রদেশে অবশ্য এখন উল্টো ধাক্কা খাচ্ছে বিজেপি। সেখানে ভোটের আগে বিজেপিতে ব্যাপক ভাঙ্গন। আজকের দিনে মনোহর পারিক্কারের প্রয়াণের পরে গোয়াতে আবার সরকার গঠন নিয়ে গোলমাল চলছে। কর্নাটকেও ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস অল্প ব্যবধানে জেতার পর বিজেপির দিক থেকে ঘর ভাঙানোর চেষ্টার গল্প শোনা গেছে। সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে আগের বিভিন্ন রাজত্বে কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে এই একই ঘটনা ঘটিয়েছে কংগ্রেস। বিধানসভা, লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্যদের একদল থেকে অন্যদলে চলে যাওয়া একা বিজেপি করাচ্ছে একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। এ রাজ্যের পঞ্চায়েত স্তরে এই ছবি তো প্রতিদিন আঁকা হয়েছে। তাই ভোটে জেতার পর দলত্যাগী নেতার কৃতকর্মে নির্বাচকমণ্ডলীর মৌলিক অধিকার হননের যে বাস্তবতা তার জন্যে বামপন্থীরা বাদে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই দায়ী। ঘোড়া কেনাবেচার উত্তরণ এখন রিসর্ট রাজনীতিতে। কর্নাটকের রিসর্ট রাজনীতিতে বিজেপি এবং কংগ্রেস দু-দলকেই নোবেল দেওয়া যায়। কংগ্রেস আবার দল সামলানোর চিত্রনাট্যে একটু এগিয়ে। সংবাদমাধ্যমে শোনা গেছে যে মাস কয়েক আগে এক রিসর্টে ভোররাত অবধি উৎসবের শেষে বোতল হাতে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক মারামারি করেছেন তাঁরা। তারপর সেই ঘটনা চাপা দিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বিধায়কের অসুস্থতাকে হৃদয় দৌর্বল্য বলে চালানো হচ্ছে।

দলবদলের পেছনে যেমন থাকে ক্ষমতার আস্ফালন, আবার জনগণের কাছে তা নেতাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অস্ত্রও বটে। শুরুতে ক্ষমতার কথায় আসা যাক। সংবিধান যাই বলুক না কেন, ক্ষমতা সবসময়েই থাকে অল্প কিছু মানুষের হাতে। তাদের কেউ বড় ব্যবসায়ী, কেউ পরীক্ষায় পাশ করা প্রশাসক, কেউ থানার বড়বাবু, কেউ বা জজ-ব্যারিস্টার। কিন্তু সবার থেকে জনগণের বেশি নজর থাকে রাজনৈতিক নেতাদের দিকে। তাঁরা দল বদল করেন, ক্ষমতার আস্ফালন দেখান, ভোট লুঠ করেন, প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। ক্ষমতায় থেকে কিছু কাজের কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা বারবার প্রমাণ করেন নিজেদের দাদাগিরি এবং অক্ষমতাও। আর ক্ষমতায় থাকলে তবেই তো লোকে সমালোচনা করবে। লেনিন বা ফিদেল কাস্ত্রোকে সেই জন্যেই ট্রটস্কি কিংবা চে গুয়েভারার থেকে তুলনায় খারাপ মানুষ মনে হয়। আজকের দিনে সিপিএমকে নিয়ে বিশেষ সমালোচনা শোনা যায় না কারণ তারা আর পশ্চিমবঙ্গের মসনদে নেই। সেইরকমই কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার জন্যেই মোদী আর অমিত শাহ জুটির এতো নিন্দে শোনা যাচ্ছে। আর সেটা যে শোনা যাচ্ছে তাতেই কিছুটা স্বস্তি যে দেশে এখনও সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। ক্ষমতাশালীরা যে আমাদের দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হারান সেটাই ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্বের সবথেকে বড় প্রমাণ আর সেখানে জনগণের দলবদল গণতন্ত্রের ইতিবাচক সুফল। গত বছরের শেষেই হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে ভোটে হেরে বিজেপি প্রমাণ করেছে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র এখনও নিশ্চিহ্ন হয় নি।

আরও পড়ুন, ভোটে কী করবে বাংলার নকশালরা?

রাজনীতিতে অনেক সময় অযৌক্তিক এবং গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তায় আমরা বিরক্ত হই। যেমন শোনা যাচ্ছে যে সামনের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে নাকি বিজেপি ২০৫০ অবধি আর পেছন ফিরে তাকাবে না। এমনটাই কোন এক বক্তৃতায় বলেছেন অমিত শাহ। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ বলেছেন এটাই নাকি ভারতের শেষ নির্বাচন। এতে বিজেপি জিতে আসার পর আর ভোটযন্ত্র কিংবা ব্যালট নিয়ে তর্কের প্রয়োজনই হবে না। বিরোধীরা এই ধরণের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলছেন যে জনমতের সাহায্যে নয়, সংবিধান সংশোধন করে অনন্তকাল ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা করবে ফ্যাসিবাদী বিজেপি। মুশকিল হল আমাদের চেনাশোনা অনেক মানুষই কংগ্রেস, সিপিএম, অতিবাম কিংবা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গেছেন। তৃণমূলের অনেক নেতার কথায় জলবাতাসা, নকুলদানা, ঢাকের বাদ্যি ইত্যাদি পুজোর উপকরণ। মনে রাখতে হবে সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপি থেকেও অনেকে ঢলে পড়েছেন এই তৃণমূলের দিকে। উঁচুতলার নেতা থেকে নীচুতলার সমর্থক সবার জন্যে একথা সত্যি। তাই বিজেপির শেষ ভোট কিংবা আগের বারের কংগ্রেস মুক্ত ভারত, তৃণমূলের বাজানো বামেদের মৃত্যুঘণ্টা এই সমস্ত কথাগুলো এমন অনেক মানুষ বলছেন যারা কিছুদিন আগেই অন্যপক্ষে ছিলেন। ফলে ভালোমন্দের বিচার এখানে ভীষণ জটিল। বাম আমলে বিধানসভা নির্বাচনে বামপ্রার্থী যেখানে বিপুল ভোটে জিততেন, সেখানে আজকে একইরকম অস্বাভাবিক ব্যবধানে জেতেন তৃণমূল প্রার্থী। অর্থাৎ সেখানে স্বচ্ছ নির্বাচন হলে অধিকাংশ মানুষ দলবদল করেছেন, অথবা সেখানে ঠিকঠাক ভোটটাই হয় না, দলবদল করেন ভোট করানো নেতারা।

লোকসভা নির্বাচনের আগে নেতাদের দলবদলের বিষয়টি এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের রাজ্যে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভোটের আগে বা পরে রাজনৈতিক কর্মী বা জনপ্রতিনিধিদের দলবদলের প্রবণতা বেড়েছে এই রাজ্যে। কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যাওয়াটা অনেক স্বাভাবিক, কারণ একটি দল থেকেই অন্যদলের সৃষ্টি। তবে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর বাম দলের প্রচুর নেতা কর্মীও দলবদল করেছেন, এবং এখনও তা চলছে। এবারের লোকসভা ভোটের আগে বিষটিতে যে সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে তা হল তৃণমূল থেকেও অনেকে যাচ্ছেন বিজেপির দিকে। তবে আজকের দিনে এই খুচরো দল ভাঙার উদাহরণগুলির খুব সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব আছে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ এগুলি মোটেই সিপিআই ভেঙে সিপিএম (তাত্ত্বিক নীতির লড়াই) কিংবা কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল (প্রধান বিরোধী নেতা হওয়ার লড়াই) এইধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে তুলনীয় নয়। তৃণমূল থেকে যে কিছু বড় মাপের নেতা বিজেপিতে গেলেন তাতে চমক যথেষ্ট আছে। হয়ত আসনের সংখ্যার হিসেবেও কিছু রদবদল হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ মনে করবেন যে এক দলের টিকিটে প্রার্থী হতে না পেরে অন্যদলে চলে গেলেন কিছু নেতা। নীতিবদলের প্রশ্নটা এখানে দলবদলের ছুতো মাত্র। তবে যদি এমন হয় যে এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল, তাহলে অবশ্যই এই দলবদলগুলোর রাজনৈতিক তাৎপর্য বাড়বে অনেক বেশি। তবে এখনও এ রাজ্যে পরিস্থিতি তৃণমূলের পক্ষে অতটা খারাপ বলে মনে হয় না। ঘটনা ঘটছে অন্য রাজ্যেও। শোনা যাচ্ছে বিহারে একই কেন্দ্র থেকে এবার বিজেপির বদলে কংগ্রেসের হয়ে প্রার্থী হতে পারেন শত্রুঘ্ন সিনহা। নির্বাচনী রসায়নে দলবদলের ঠিকভুল তাই অঙ্কের হিসেবে বিচার না করাই ভালো।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

lok sabha 2019
Advertisment