কোন কিছুর উদাহরণ দিতে হলে আমরা বলি না, "এই যেমন ধরুন?" তা সেই 'যেমন ধরুন'-এর কিছু নমুনা দেওয়া যাক শুরুতে।
"ছেলে ঢুকিয়ে দেব ঘরে, আমি চন্দননগরের মাল।"
"রথের চাকায় তলায় পিষে মারব আটকাতে এলে।"
"রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। যে সামনে আসবে, তার জন্য চড়াম চড়াম ঢাক বাজবে (পড়ুন, পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে দেওয়া হবে)।"
"পুলিশ শাসক দলের চাকর। দেখলেই লাঠি-বাঁশ দিয়ে পেটান।"
"আপনাদের সাংবাদিকদের পিন মারা ছাড়া কাজ নেই? ওই পিন নিজেদের পিছনে ঢোকান।"
আছে, আরও অনেক 'মণিমানিক্য' আছে। লিখতে গেলে তালিকা বাড়তেই থাকবে। উপরে যে 'সুভাষিত'-র নমুনা পেশ করেছি, তার প্রত্যেকটিই পাঠকের স্মরণে থাকবে নিশ্চিত। কোন বাণীটি কোন রাজনৈতিক দলের কোন নেতা বা নেত্রীর মুখ থেকে অবলীলায় বেরিয়েছিল, তা-ও মনে থাকার কথা অবধারিত।
আরও পড়ুন: আরও আরও আরও যাক প্রাণ?
কে বলেছিলেন, কখন বলেছিলেন, সেটা ততটা প্রাসঙ্গিক নয়। যেটা প্রাসঙ্গিক, এবং উদ্বেগের, সব রাজনৈতিক দলই কুকথা-রোগে আক্রান্ত। ডান-বাম-গেরুয়া, কেউ বাদ নেই রোগীর তালিকায়। এবং যত দিন যাচ্ছে, রোগ আকার নিচ্ছে দুরারোগ্য মহামারীর। শালীনতাকে হেলায় বন্ধক রেখে বঙ্গীয় রাজনীতির আঙিনায় যেন খিস্তিখেউড়ের মহোৎসব শুরু হয়েছে। ঘোমটার আড়ালটুকুও আর রাখার প্রয়োজন মনে করছেন না নেতানেত্রীদের একটা বড় অংশ। খুল্লমখুল্লা চলছে অকথা-কুকথার খ্যামটা নাচ। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। অমুক বলে আমায় শোন, তো তমুক বলে আমায়।
কোথায় ঘটছে সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা-রুচি-সৌজন্য শিকেয় তুলে এই গা গুলিয়ে-ওঠা বাকযুদ্ধ? বাংলায়, যা নাকি সংস্কৃতির পীঠস্থান, যা বৌদ্ধিক চর্চার উৎকর্ষে সারা দেশের থেকে এগিয়ে আছে দাবি করি আমরা। সেই বাংলায়, যার আর কিছু না থাক, সমৃদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার ইতিহাস আছে বলে গর্বে মাটিতে পা পড়ে না আমাদের। সেই গর্বের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে ফেলছেন আমাদের রাজনীতিকরা। ঘটমান বর্তমান যা খেল দেখাচ্ছে, পুরাঘটিত অতীতের গল্পকথায় কী লাভ আর? ভাবের ঘরে চুরি করে কী হবে আর, কী হবে আর ইতিহাসের আরামকেদারায় ঠেস দিয়ে?
অথচ বঙ্গ-রাজনীতির ইতিহাস তো সত্যিই ছিল গর্ব করার মতো। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তরজা হবেই, স্বাভাবিক।বাকযুদ্ধের চাপানউতোর হবে, স্বাভাবিক। আগেও হতো। বিধানসভায় হত, মাঠে-ময়দানে হতো, নির্বাচনী সভায় হতো। কিন্তু শালীনতার লক্ষণরেখা অতিক্রম করতেন না কেউ, রাজনীতির লড়াই নেমে আসত না কদর্য ভাষায় কাদা-ছোড়াছুড়িতে। সে অজয় মুখার্জী হোন বা প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু হোন বা সিদ্ধার্থশংকর রায়, পারস্পরিক রাজনৈতিক বিরোধিতা কখনও 'মেরে ফেলব, কেটে ফেলব, পিষে ফেলব'-র স্তরে অধঃপতিত হয়নি। একটা আগল ছিল। সে আগল সৌজন্যের, শিক্ষার, রুচির।
আগল আর নেই। বাঁধ ভেঙে গেছে। রোগের লক্ষণ ধরা পড়েছিল পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের শেষ কয়েক বছর থেকেই, যখন বর্ষীয়ান অশীতিপর কৃষক নেতা বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বলে ফেলেছিলেন, "চারদিক দিয়ে ঘিরে লাইফ হেল করে দেব" কিংবা, "এখানে ওরা এলে এলাকার মহিলারা পিছন দেখাবে।" সেই যে শুরু হল, চলতেই থাকল এ পক্ষ বনাম সে পক্ষ। কে কত কুরুচি প্রদর্শন করতে পারে, তার ইঁদুরদৌড় চালু হয়ে গেল রমরমিয়ে। পরিণতি, আমরা দেখছি রোজ, শুনছি রোজ, পড়ছি রোজ। এবং আশ্চর্যের আর দুর্ভাগ্যেরও, কোনও দলের নেতৃত্বের তরফেই এই গালাগালির স্রোতে বাঁধ দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছাও চোখে পড়ে না। জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া হলে একটা নাম-কা-ওয়াস্তে তিরস্কার। কিছুদিন পর আবার যেই কে সেই, 'মাইরা ফেলুম, কাইট্যা ফেলুম'। 'বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও'-এর মাত্রাছাড়া কটুকাটব্য।
রাজনীতির তরজার আধার যে যুক্তি-বুদ্ধি-চেতনা জাত মানসিক শীলন, সেই বোধের অন্তর্জলি যাত্রা ঘটে গিয়েছে বাংলায়। শিক্ষায় রাজনীতির থেকে যে ঢের বেশি প্রয়োজন রাজনীতিতে শিক্ষার, সেই উপলব্ধির স্মরণসভা আয়োজন করার সময় এসে গিয়েছে নিঃসংশয়।
ভোট আসছে। নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষিত হল বলে। ভয় হয়। ভয় হয়, কতটা কুৎসিত চেহারায় দেখা দেবে প্রচারের গালাগাল-গাথা? শেষ কোথায়?
শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!