গৌতম ঘোষদস্তিদার
ধর্ষক-খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাষ্ট্রও আসলে নিজস্ব হিংস্রতায় মান্যতা দেয় কি না, এই প্রশ্নের মীমাংসা সুদূরপরাহত। কেননা, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে কেন্দ্র (এখন কার্য্ত প্রধানমন্ত্রী) ইচ্ছামতো ফাঁসির সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। সাম্প্রতিক বহু বিষয়ের মতো সংসদে উত্থাপিত না-করে, নিছক মন্ত্রিসভায় ‘আলোচনা’ করেই, শনিবার চটজলদি শিশুধর্ষণ-খুনে অপরাধীকে প্রাণদণ্ডের অধ্যাদেশ জারি করেছে। বিষয়টি যে সম্পূর্ণতই রাজনৈতিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, সম্প্রতি উন্নাও ও কাঠুয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় শাসকদলের নেতা-কর্মীদের যুক্ত থাকার অভিযোগে দেশে যে-ভাবে জনমত প্রবল হয়েছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে বিক্ষোভের মুখে পড়ে যেমন মৌনতা ভেঙে ফের কন্যাদের ‘সুবিচার’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন, তেমনই দেশে ফিরে নিজের ও দলের মুখরক্ষার জন্য এমন চমকপ্রদ কোনও সিদ্ধান্ত না-নিয়ে উপায় ছিল না তাঁর। সবটাই যে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
অবশ্য, এমন শাক-দিয়ে-মাছ-ঢাকার ঘটনা আমরা দেখেছি ২০১২ সালে রাজধানীর বুকে নির্ভয়ার ধর্ষণ-খুনেও। সেই বীভত্সতম অপরাধে দেশ জুড়ে অভূতপূর্ব বিক্ষোভ ও আলোড়নের জেরে ইউপিএ-সরকারও চটজলদি ফাঁসির সংশোধিত আইন এনেছিল। কেননা, দিল্লিতে তখন নির্বাচনের মুখে শীলা দীক্ষিতের দলীয় সরকারটি রক্ষা করার দায় ছিল কংগ্রেসের। নির্ভয়াকে রাতারাতি সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেও শেষরক্ষা হয়নি শীলার। এখনও সেই দোষীদের চরম শাস্তি হয়নি। বরং, জেলহেফাজতে এক অপরাধীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। একইভাবে, সংশোধিত আইন-মোতাবেক মুম্বাইয়ের শক্তি মিলস দলধর্ষণের অপরাধে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড হলেও, আজও তা কার্য্কর হয়নি। কেবল তা-ই নয়, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খুনি-ধর্ষকদের ৮৯-শতাংশ মামলাই স্থগিত রয়েছে। ফলে, বিষয়টি স্বচ্ছ-ভারতের মতোই পরিষ্কার যে, কেন্দ্রের এই তথাকথিত ‘কড়া’ পদক্ষেপ, আরও নানা-বিষয়ের মতোই একটি ফোলানো-বেলুনমাত্র।
আরও পড়ুন- রমনার বটমূল কেঁপে উঠেছিল বিস্ফোরণে
কেবল যে সাধারণ মানুষেরই এমন চটকদারি আইন বিষয়ে অবিশ্বাস ও অনাস্থা আছে, তা-ই নয়। বিচারপতিদের একাংশও অতীতে তেমনই মতপোষণ করেছেন। আমাদের মনে পড়বে, নির্ভয়া-দলধর্ষণ মামলার পরে গঠিত সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জগদীশ শরণ ভার্মার নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টে স্পষ্টতই জানানো হয়েছিল, ফাঁসির হুকুম একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ। সামগ্রিকভাবে তাই নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিকতম চমকে মানুষ ভুলবে বলে মনে হয় না।
উন্নাও ও কাঠুয়ার ধর্ষণ-খুনের প্রেক্ষিতে বহুপ্রাচীন দাবিটিই ফের ছড়িয়ে পড়েছে দেশের চারদিকে যে, ফাঁসির মতো চরম শাস্তি ছাড়া এমন নৃশংস অপরাধ দমন করা অসম্ভব। এই মতটি যে আসলে একটি গুজবমাত্র, তা ভেবে দেখার সময় পেরিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সেই তামাদি দাবিটিই শাসকদলেরও আয়ুধ। কেননা, উন্নাওয়ে দলীয় বিধায়ক ও কাঠুয়ায় হিন্দুত্ববাদী পুলিশ-পুরোহিতের অপরাধযোগ ও অভিযুক্তদের পক্ষে শাসকদলের প্রকাশ্য সমাবেশ আড়াল করতে ওই অচল-আধুলিটিই একমাত্র সম্বল বিজেপি-র। আমাদের মনে পড়বেই, কলকাতায় ১৪-বছরের স্কুলছাত্রী হেতাল পারেখকে ধর্ষণ-খুনের অপরাধে ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ থেকে ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট পর্য্ন্ত জেল খেটে ১৪ আগস্ট ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব গৃহরক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। মৃত্যুর আগে পর্য্ন্ত তিনি অবিচল ছিলেন অপরাধ-অস্বীকারে। দেশে আর-কেউ এক-অপরাধে একসঙ্গে দুটি শাস্তি ভোগ করেননি। সেই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতেও ছিল তাঁর ফাঁসির পক্ষে এক গণ-উন্মাদনা জাগিয়ে তোলা। সেই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিল একটি বামপন্থী-সরকার (সাম্প্রতিক অধ্যাদেশ বিষয়ে বৃন্দা কারাট আগ বাড়িয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা নীতিগতভাবে ফাঁসির বিরোধী।) ও সংবাদমাধ্যম। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্র স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য্র মাধ্যমে সিপিয়েম বিষয়টিকে রাজনীতিনিরপেক্ষ করার চেষ্টা করেছিল। অভূতপূর্ব ঘটনা যে, তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী ছিলেন সাংবাদিক কুণাল ঘোষ (পরে তিনি বুদ্ধবিরোধিতা করবেন, সাংসদ হবেন, আর্থিক দুর্নীতির দায়ে জেল খাটবেন)। তাঁদের যুগলবন্দি সভান্তরে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে সরব হয়েছিল। কুণালের সংবাদপত্রে সেইসব সভার ফলাও খবর বের হত। কিন্তু, পরে জানা গেছে, ধনঞ্জয়ের দাবি হয়তো অমূলক ছিল না। অন্যদিকে, ধনঞ্জয়ের চরম-শাস্তির পরেও, রাজ্যে বা দেশে ধর্ষণ-খুনের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। দেশে ধনঞ্জয়ের মতো গরিবদের বলির পাঁঠা করার সহজ পথেই হেঁটেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু, তাঁর চেয়ে নৃশংস অপরাধ করেও চণ্ডীগড়ের ব্যবসায়ী নারীমাংসখাদক মনিন্দর সিং পন্ধের এখনও ফাঁসিতে ঝোলেনি। কিশোরী আরুষি ও পরিচারক হেমরাজের খুনের কোনও কিনারাই করতে পারেনি দোর্দণ্ড সিবিআই। আদালতে বেকসুর হয়েছেন রাজেশ ও নূপুর তলোয়ার। বোঝা গেছে, আরুষি-হেমরাজকে কেউই খুন করেনি।
আরও পড়ুন- নন্দীগ্রামে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলেন লেখক-শিল্পীরাও
লক্ষণীয়, কেন্দ্র নতুন অধ্যাদেশে ঊর্ধ্বতম বারো-বছর-বয়সি কন্যাদের ধর্ষণে সর্বোচ্চ ফাঁসির সাজা বলবত্ করেছে। উন্নাওয়ের ধর্ষিতর বয়স বারোর বেশি বলেই এমন সিদ্ধান্ত, তেমন সন্দেহের কারণ না-থাকলেও, এর প্রেক্ষিতে ধর্মবাদী সরকারেরে একটি অভিপ্রায় প্রচ্ছন্ন থাকেই। দেশে ওই-বয়সি অরজস্বলা মেয়েদের কুমারীজ্ঞানে পুজো করার একটি রীতি সুপ্রচলিত। শৈশব থেকেই মেয়েদের উপর দেবীত্ব আরোপ করার প্রবণতা পুরুষতন্ত্রের একটি চেনা ছক। সেই মনুবাদী পুরুষতন্ত্রই আবার নারীকে ‘নরকের দ্বার’ হিসাবেও দেখে। কেন্দ্র যে ‘নাবালিকা’-র মধ্যেও এক বিভাজন ঘটাল, তা নিশ্চয়ই অবিবেচনাপ্রসূত নয়।
অথচ, নতুন অধ্যাদেশে কিন্তু ‘নাবালক’ ধর্ষকদের শাস্তির কোনও রকমফের ঘটানো হয়নি। প্রাপ্তবয়স্কদের মতো একটি অপরাধ করে নিছক বয়সের কারণে তাদের সঙ্গে গান্ধীগিরি করার প্রবণতা থেকে মুক্ত হয়নি হিন্দুত্ববাদীরা। তা যে তাদের মহানুভবতা, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তা যে আসলেই সুকুমারমতি ছেলেদের মনে প্রবল নারীবিদ্বেষ ও আধিপত্যবোধ তৈরি করারই এক প্রচ্ছন্ন প্রবণতা নয়, তা কে বলে দেবে!
আরও পড়ুন- সংবাদ জগতের একাল-সেকাল