Advertisment

বিজেপির কোন উদ্দেশ্য সাধন করছেন 'সাধ্বী' প্রজ্ঞা?

বিজেপি অভিযোগ করা শুরু করে যে হিন্দু সংগঠনদের জোর করে জড়ানো হচ্ছে, যদিও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই মহারাষ্ট্র পুলিশের তরফ থেকে এই সমস্ত অভিযোগ করা হয়েছিল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sadhvi pragya joins bjp

সাধ্বী প্রজ্ঞা। ফাইল ছবি

২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ছ'জন মানুষ, আহত শতাধিক। সারা দেশ জুড়ে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোড়ন পড়ে যায়, এবং প্রথা মেনেই এই সন্ত্রাসবাদী হামলার সন্দেহ গিয়ে পড়ে ইসলামি মৌলবাদী সংগঠনের ওপর। বিস্ফোরণের প্রাথমিক তদন্তের ভার ন্যস্ত হয় মহারাষ্ট্র অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াডের হেমন্ত কারকারের কাঁধে। তাঁর এবং তাঁর দলের তদন্তে পাওয়া যায় যে মালেগাঁও বিস্ফোরণের মূল চক্রীরা ঘটনাচক্রে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

Advertisment

যে নামগুলো এই তদন্তে প্রথমিকভাবে উঠে আসে, তাদের মধ্যে অন্যতম সাধ্বী প্রজ্ঞা ঠাকুর, শিব নারায়ন গোপাল সিং এবং শ্যাম সাহু। এই তিনজনকে মহারাষ্ট্র পুলিশ ২৪ অক্টোবর, ২০০৮ সালে গ্রেফতার করে। বিস্তারিত তদন্তে জানা যায়, আরও বেশ কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ২০০৮ সালেরই ৪ নভেম্বর প্রাক্তন সেনা কর্মচারী কর্নেল পুরোহিতকেও গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ততদিনে এই ঘটনা রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে। বিজেপি অভিযোগ করা শুরু করে যে হিন্দু সংগঠনদের জোর করে জড়ানো হচ্ছে, যদিও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই মহারাষ্ট্র পুলিশের তরফ থেকে এই সমস্ত অভিযোগ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: বিজেপিতে যোগ দিয়ে সাধ্বী প্রজ্ঞা বললেন, ভোটে জিতব

শুধু তাই নয়, মহারাষ্ট্র পুলিশ এও দাবি করে যে ২০০৬ সালের গুজরাটের মোদাসা বিস্ফোরণ, ২০০৭ সালের হায়দ্রাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণ এবং সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণের সঙ্গেও এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি জড়িত থাকতে পারে। ২০০৮ সালের অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস মিলিয়ে হেমন্ত কারকারের নেতৃত্বে অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করে। এরপর চাঞ্চল্যকরভাবে হেমন্ত কারকারে মুম্বইয়ের ২৬/১১ হামলার দিন লস্কর-এ-তইবা জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে 'মারা' যান।

রাজনৈতিক চাপের মুখে ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এনআইএর হাতে। ২০১৮ সালে এনআইএ সাতজনকে দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট দাখিল করে, পাশাপাশি এও জানায় যে প্রজ্ঞা ঠাকুর এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নন। ফলে তিনি তখনকার মতো ছাড়া পান, যদিও তথ্যপ্রমাণ তাঁর বিরুদ্ধেই ছিল।

এরপর গঙ্গা দিয়ে আরও বহু জল গড়িয়েছে। এবারের নির্বাচনে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে ভোপাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। সেই নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে কিছু তর্কবিতর্ক। এটা সত্যি, যে ভারতের সংবিধানে এমন কোনও আইন নেই, যা একজন অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাদীকে নির্বাচনে লড়তে বাধা দিতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি, যে প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলে ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে রাজনীতি শাসকদল পাঁচ বছর ধরে দেশের মূলস্রোতের অঙ্গ করার চেষ্টা করে চলেছে, তা খুব সহজেই মান্যতা পেয়ে যায়।

আরও পড়ুন: সাধ্বী প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ

একদিকে যখন নির্বাচন কমিশন যোগী আদিত্যনাথ সহ অন্যান্য অনেক নেতা-মন্ত্রীকে বারবার সাবধান করছে, এবং লোক দেখানো হলেও ছোটখাটো কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন কি এটা মনে হতে পারে না যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর নীতি এবার আর শুধু বাণীর পর্যায়ে থাকবে না? সমাজের মূলস্রোতে ঢুকে পড়বে? গত পাঁচ বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে যেভাবে এই ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে, বিজেপির এই পদক্ষেপ তারই অবধারিত পরিণতি। গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র মুসলমান হবার কারণে যে ভাবে জুনেইদ, পেহলু খান, আখলাক সহ অন্যান্যদের গণপ্রহারের শিকার হতে হয়েছে, সেখানে প্রজ্ঞা ঠাকুরকে দাঁড় করানোটা কিসের ইঙ্গিত?

আসলে ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্যে এরকম একজন প্রার্থী দাঁড় করালে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় - একদিকে যেমন অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া যায়, তেমনি শুধু মুসলিম বিদ্বেষী নন, একেবারে মুসলিম-বিরোধী সন্ত্রাসবাদী হামলার সম্ভাব্য নেত্রীকে সামনে আনা যায়, যাতে হিন্দু ভোট আরও সহজে একত্রিত হয়। এই মুহূর্তে বিজেপি চায়, সমস্ত আলোচনা এককেন্দ্রিক হোক - ভারত কি হিন্দু রাষ্ট্র হবে? ২০১৪ সালে যে প্রতিশ্রুতি ছিল উন্নয়নের, সেই প্রতিশ্রুতি এই মুহূর্তে আর শোনা যাচ্ছে না, যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান ছিল, তাও আর আজকে শোনা যাচ্ছে না। কিংবা বলা ভালো, বিজেপির নতুন নেতৃত্ব শোনাতে চাইছেন না। তাঁদের এখন একটাই মন্ত্র - হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে তীব্রতর করা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করা। তাই শ্রীলঙ্কার জঙ্গি হানাতে কয়েকশো মানুষ মারা যাওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেকথা উল্লেখ করেও নিজের দেশে ভোট প্রার্থনা করেন।

আরও পড়ুন: হেমন্ত কারকারের মৃত্যু আমার অভিশাপে: সাধ্বী প্রজ্ঞা

প্রজ্ঞা ঠাকুরকে প্রার্থী করানোর আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। তিনি স্রেফ মালেগাঁও বিস্ফোরণেই অভিযুক্ত নন, সরাসরি এই বিস্ফোরণের কৃতিত্বও দাবী করতে পারেন, যার ফলে বিজেপির সমর্থকদের কাছেও এই বার্তা পৌঁছনো যায় যে, যে কোনোরকম মুসলমান-বিদ্বেষের মুখ হলো বিজেপি, এবং প্রজ্ঞা ঠাকুরেরা শুধুমাত্র কংগ্রেসের জন্য ন'বছর জেল খেটেছেন। সুতরাং কংগ্রেস কখনই হিন্দুদের ভালো করতে পারে না।

ফের সেই 'নরম হিন্দুত্ব' এবং 'গরম হিন্দুত্বের' বিতর্ক। কারণ নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি খুব ভালো করে বুঝে গেছেন, যতই তিনি উন্নয়নের কথা বলুন, সেই উন্নয়ন করতে হলে তাঁকে এই 'খেলা'-র মধ্যে থাকতে হবে, এবং তার নিজস্ব মাঠেই, হিন্দু-মুসলিম মাঠেই খেলতে হবে। উন্নয়ন তো পরে আসবে, আগে তো যেনতেন প্রকারেণ জিততে হবে। সেটার জন্য ইভিএমকে প্রভাবিত করা, মানুষের মনকে প্রভাবিত করা, সব চলতে পারে। সেই পুরোনো কথাটাই এই বিজেপি নেতৃত্ব আবার মনে করিয়ে দিলেন নাকি? 'প্রেমে এবং যুদ্ধে অসদুপায় বলে কিছু নেই'।

আরও পড়ুন: "কারকারে শহিদ": ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন প্রজ্ঞা ঠাকুর

মঙ্গলবার মালদায় ভোট হয়েছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা নিশ্চিত অনেকেই ভুলে গেছেন। মালদার শ্রমিক আফরাজুলকে রাজস্থানে কুপিয়ে, পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তারপর তার একটা ভিডিও করে সারা দেশে নিমেষে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দিয়ে একটা ভয়ের বাতাবরণ ছড়ানো যায়। যাতে সংখ্যালঘু মানুষেরা ভয় পান। সেই ভয়ের ফলে যাতে তাঁরা মাথা নিচু করে থাকেন। শোনা যাচ্ছে, সেই আফরাজুলের হত্যাকারী শম্ভুলাল রেগারকেও নাকি প্রার্থী করা হতে পারে। দক্ষিণ মালদাতে কালিয়াচকে ভোট দিয়েছেন আফরাজুলের কন্যা রেজিনা খাতুন। বলেছেন, কে জিতবে তিনি জানেন না, কিন্তু যে সরকারই আসুক না কেন, তিনি চান তাঁর বাবার হত্যাকারীর ফাঁসি হোক। অন্যদিকে ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় গণধর্ষিতা বিলকিস বানুও মঙ্গলবার প্রথম ভোট দিয়েছেন, এবং বলেছেন তিনি ঐক্যের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্ট বিলকিস বানুকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে।

এখন প্রশ্ন এটাই, শেষ বিচারে কি রেজিনা খাতুন, বিলকিস বানুরা জেতেন, না ঘৃণা বিদ্বেষের কারবারিরা? তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও একটা মাস, হয়তো বা বছর, বা আরও অনেকদিন।

(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তু বিভাগের সদস্য, মতামত ব্যক্তিগত)
ATS Malegaon Blast
Advertisment