Advertisment

তৃণমূলের তালিকা, মমতার হিসেব-নিকেশ

মাথায় রাখতে হবে যে অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় বা মুনমুন সেনের কাছে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বা বাসুদেব আচারিয়ার মতন হেভিওয়েট প্রার্থীরাও কিন্তু হেরে গেছেন এর আগে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Trinamool Congress candidate list and mamata's planning

প্রার্থী তালিকা হাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি- পার্থ পাল)

"I think voting for the lesser of two evils in game theory always leads to more evil." — Penn Jillette

Advertisment

ইলেকশন কমিশনের লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করার মাধ্যমে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে অবধি ক্ষমতাসীন শাসকদল বিজেপি নোটবন্দি, শিক্ষা,কর্মসংস্থান এবং বিরোধীদের তোলা রাফাল বিমান কেনা সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে বেশ বেহাল দশায় ছিল।পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং বালাকোটে ভারতীয় বায়ূসেনার জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংসের দাবির পর সাম্প্রতিক সার্ভেগুলিতে বিজেপির প্রতি জনসমর্থন খানিক হলেও বাড়ছে দেখা গেছে। পরিণত রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে উজ্জীবিত কংগ্রেস এবং বিরোধী দলের জোট বনাম নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি, এই পরিস্থিতিতে এবারের লোকসভা ভোট হতে যাচ্ছে। উন্নয়নের প্রশ্নে বিজেপিকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে বিরোধীরা আর রাম মন্দির এবং দেশপ্রেমের ঢেউ তুলে নির্বাচন পেরোতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের সবকটি দখলের ডাক দিয়েছেন। আর অন্যদিকে অমিত শাহ হুঙ্কার দিয়েছেন যে এই রাজ্যে তারা গোটা কুড়ি আসন দখল করবেনই। বাম এবং কংগ্রেস অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে ব্যস্ত।



১২ই মার্চ  সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের জন্যে তাদের প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেছে।বিগত লোকসভা ভোটে তৃণমূল জিতেছিল ৩৪টি আসনে। জয়ীদের মধ্যে এবার ১০ জনকে টিকিট দেওয়া হয়নি। এরমধ্যে দলত্যাগী সাংসদ সৌমিত্র খান এবং অনুপম হাজরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, ফলে রইল বাকি আট। সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকবেন বলে সরে দাঁড়িয়েছেন সুব্রত বক্সী, উমা সোরেন এবং ইদ্রিশ আলি। সন্ধ্যা রায় ভোটে দাঁড়াতে চান নি বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা করেছেন। অধ্যাপক সুগত বসু তার কর্মস্থল থেকে অনুমতি পান নি বলে জানিয়েছেন। অভিনেতা তাপস পাল এবার আর টিকিট পাবেন না সেটা জানাই ছিল। কোচবিহারের পার্থপ্রতিম রায় এবং রাণাঘাটের তাপস মণ্ডলকে টিকিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত তৃণমূলের নিজস্ব। নতুন প্রার্থীদের মধ্যে চমকের শীর্ষে আছেন দুই টলিউড অভিনেত্রী, যাদবপুরের প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী এবং বসিরহাটে নুসরাত জাহান।এছাড়া রাণাঘাটে দাঁড়াচ্ছেন সাম্প্রতিককালে খুন হওয়া তৃণমূল নেতা সত্যজিত বিশ্বাসের স্ত্রী রূপালী বিশ্বাস। যেটা উল্লেখ্য যে মোট প্রার্থী তালিকার প্রায় ৪১% হলেন মহিলা। এবং এই পদক্ষেপ নিশ্চতভাবে প্রশংসার দাবি রাখে।

প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল তার নিজস্ব সমীকরণে ভোটের রণসজ্জা সাজায়।আমরা বাইরে থেকে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করতে পারি মাত্র। তৃণমূল নেত্রী বরাবরই চমক দিতে ভালোবাসেন এবং এর আগেও টলিউড বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে তিনি প্রার্থী করেছেন। বালুরঘাটের সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এসেছেন নাট্যজগত থেকে। প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমন প্রখ্যাত গায়ক। অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী বা নুসরাত জাহানের রাজনৈতিক পরিপক্কতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কতটা রাজনৈতিকভাবে কমিটেড হবেন সেটা নিয়েও সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় বা মুনমুন সেনের কাছে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বা বাসুদেব আচারিয়ার মতন হেভিওয়েট প্রার্থীরাও কিন্তু হেরে গেছেন এর আগে। দক্ষিণ কলকাতায় মালা রায় তাঁর আনুগত্য এবং কাউন্সিলর হিসেবে কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি পেলেন। এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে লোকসভা রাজনীতির আঙিনায় টেনে আনা নিশ্চয়ই আরেকটি চমক। বাঁকুড়াতে এর আগে ছিলেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন। এলাকায় তাঁর অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ সেসব সমস্যা কাটিয়ে উঠবেন আশা করেই দল তাকে প্রার্থী করেছে। ঝাড়গ্রামে উমা সোরেনের টিকিট গেছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিজেপির উত্থানের ফলে। তাঁর জায়গায় প্রার্থী হয়েছেন বীর বাহা সোরেন। উচ্চশিক্ষিতা এই মহিলা পেশায় শিক্ষিকা। এই প্রার্থীকে নির্বাচনের মাধ্যমে পিছিয়ে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি সরকার যে যত্নশীল সেটাই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। মমতাবালা ঠাকুরের টিকিট পাওয়া অবশ্যম্ভাবীই ছিল। তবে তিনিও এবার ভোটে লড়াইয়ের সামনে পড়বেন।

আরও পড়ুন, মমতার অ্যাকশন, নবীনের প্রতিশ্রুতি, তবু মহিলা সংরক্ষণ সেই তিমিরেই

রায়গঞ্জে কানাইলাল আগরওয়ালকে প্রার্থী করাটাও সেই রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেই। উত্তরবঙ্গে বিজেপির প্রভাব বাড়ছে। সঙ্ঘপরিবারের শাখা সংগঠনগুলির দীর্ঘকালীন উপস্থিতির ফলে মেরুকরণের প্রভাব দেখা দিচ্ছে। কানাইলাল আগরওয়ালকে  সম্ভবত দাঁড় করানো হয়েছে বিজেপির সংখ্যাগুরু ভিত্তিক ভোটকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে। কোচবিহারে পার্থপ্রতিম রায়কে টপকে টিকিট পেয়েছেন দল বদলে তৃণমূলে আসা পরেশ অধিকারী। এবং প্রার্থী ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনেই স্পষ্ট যে বিদায়ী সাংসদ পার্থপ্রতিম রায়ের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে দলের অভ্যন্তরে প্রশ্ন আছে।বসিরহাট কেন্দ্রে নুসরাত জাহানকে দাঁড় করানোর কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে বসিরহাট সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়েছে একাধিকবার।সেখানকার সাংসদ ইদ্রিশ আলি’র দিকেও ব্যর্থতার আঙ্গুল উঠেছে পরিস্থিতি না নিয়ন্ত্রণ করতে পারার জন্যে। নুসরাত যদি তার গ্ল্যামার দিয়ে ব্যর্থতা ঢেকে দিতে পারেন, তাহলে তৃণমূলের লাভ বই ক্ষতি হবেনা। ব্যারাকপুর সিট নিয়ে বিধায়ক অর্জুন সিংয়ের ক্ষোভ প্রশমিত না হলে দীনেশ ত্রিবেদীর লড়াই আরো কঠিন হবে তা বলায় যায়।



জঙ্গিপুরে দাঁড় করানো হয়েছে খলিলুর রহমানকে। এতে প্রণব পুত্রের প্রতি সহানুভূতির অংক টের পাচ্ছেন অনেকে। বহরমপুরে অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তারই প্রাক্তন সহচর কান্দীর বিধায়ক অপূর্ব সরকার। অধীর চৌধুরীকে হারাবার জন্যে অপূর্ব সরকার যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকছে কারণ অপূর্ব সরকারের কান্দীর বাইরে প্রভাব সেভাবে নেই। মুর্শিদাবাদে তৃণমূলের ভালো ফল করার বিপক্ষে আরেকটা বড় কারণ জেলা নেতৃত্বের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। উত্তর মালদাতে মৌসম বেনজির নূর কংগ্রেস থেকে এসে ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তিনি টিকিট পাবেন সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে, মালদার রাজনীতিতে গণি খান নামক মিথের প্রভাব খানিক হলেও কমেছে। গোটা উত্তরবঙ্গের মতই, মালদাতেও বিজেপির উত্থান হয়েছে। সেক্ষেত্রে উত্তর মালদা সিটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে এটা ধরে নেওয়া যায়।

আরও পড়ুন, লড়াইয়ের জন্য আমি তৈরি: নুসরত জাহান

মানুষ আশা করছেন যে লোকসভা ভোট অন্যরকম হবে। বিগত পঞ্চায়েত ভোটে শাসক দলের দাপট নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছিল। পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং ইলেকশন কমিশনের সদিচ্ছা থাকলে লোকসভা ভোট তৃণমূলের কাছে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। বাংলার মসনদ দখলের পর তৃণমূল সুপ্রিমো দিল্লির রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে যতবেশি সাংসদ তাঁর কাছে থাকবেন, কেন্দ্রে সরকার গঠনের দর কষাকষিতে তিনি ততই সুবিধাজনক জায়গায় থাকবেন। সীমান্ত যুদ্ধের হাওয়ায় বিজেপি খুব দ্রুত ঘর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত। সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিককালের সার্ভে অনুযায়ী গোটা দেশে বিজেপির হাল খারাপ হলেও এরাজ্যে তাদের সিট বাড়তে পারে। বাম-কংগ্রেস জোট নিয়ে সম্পূর্ণ দোলাচল এখনও কাটেনি। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের সব সিটে প্রার্থী ঘোষণা করে তৃণমূল অবশ্যই বাকি রাজনৈতিকদলগুলির থেকে একধাপ এগিয়ে রইলো। দু-একদিনের মধ্যে বাকিদলগুলিও পুরোদস্তুর প্রচারে নামবে। ভোটে জেতার জন্যে হাজারো সমীকরণ কষা হবে। সবার উপরে থাকা জনতা জনার্দন কার দিকে যাবেন এখন সেইটাই দেখার।

(লেখক পেশায় অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তগত)

Mamata Banerjee lok sabha 2019 tmc
Advertisment