পৃথিবীর ইকুয়েটর অর্থাৎ বিষুবরেখার ঠিক উত্তরে ভারত মহাসাগরে পূর্বদিক হলো বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর। ভারতের দুই উপকূলে এই দুই সাগরের ওপর বছরের যে কোনও সময় দেখা দিতে পারে ট্রপিক্যাল সাইক্লোন বা গ্রীষ্মপ্রধান ঘূর্ণিঝড়। যেমন এখন বঙ্গোপসাগরের ওপর ঘনীভূত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় আমফান, যাকে বলা হচ্ছে 'সুপার সাইক্লোন', যা ১৯৯৯ সালের পর এই অঞ্চলে দ্বিতীয়। ঘূর্ণিঝড় আমফানের বেগ হতে পারে ১৬৫-১৭৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা, তবে সর্বোচ্চ বেগ ১৮৫ কিমি পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
ভারত মহাসাগরের উত্তরপূর্বে বঙ্গোপসাগরে জন্ম হয়েছে এ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের অনেকগুলির। ভারত ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশ বলতে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, এবং থাইল্যান্ড। সাম্প্রতিক অতীতে আজ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় নিঃসন্দেহে ১৯৯৯-এর ওড়িশার নামহীন সুপার সাইক্লোন।
তবে তাকে অনেক গুণ ছাপিয়ে যায় ১৯৭০-এর ভোলা ঘূর্ণিঝড়, যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ে ১১ নভেম্বর, যদিও ক্ষতির পরিমাণ বাংলাদেশে ছিল ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। আজ পর্যন্ত নথিভুক্ত হওয়া সবচেয়ে বিধ্বংসী ট্রপিক্যাল সাইক্লোন এটি, এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলির একটি। ভয়াবহ এই ঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৫ লক্ষ মানুষ, ডুবে গিয়েছিল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বা 'ডেল্টা'র অসংখ্য ছোটবড় দ্বীপ, ভেসে গিয়েছিল অসংখ্য গ্রাম। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ দাঁড়িয়েছিল ১৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা।
অন্যদিকে ভারত মহাসাগরের উত্তরপশ্চিম ভাগে অবস্থিত আরব সাগরের উপকূল ভাগাভাগি করে নিয়েছে ভারত, ইয়েমেন, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইরান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, এবং সোমালিয়া। এই সমুদ্রের ওপর দিয়েই প্রতিবছর ভারতে প্রথম প্রবেশ করে মৌসুমি বায়ু।
১৮৯০ থেকে নথিভুক্ত হয়ে আসছে উত্তর ভারত মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড়, যদিও আমাদের আলোচনায় থাকছে স্রেফ এই শতকের ভয়ঙ্করতম কয়েকটি ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, যেগুলি তাণ্ডব চালিয়েছে ভারতে। নীচে রইল সেই তালিকা।
আয়লা (২০০৯): বাংলাদেশ এবং ভারত মিলিয়ে অন্তত ৩৩৯ টি মৃত্যু, দুই দেশ মিলিয়ে গৃহহারা প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। আয়লার স্মৃতি সহজে মুছে যাওয়ার নয়। মূলত কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার সাগরদ্বীপে ২৫ মে সকালে মাটি ছোঁয় বঙ্গোপসাগর থেকে উৎপন্ন এই ঘূর্ণিঝড়, যদিও রাজ্যের একাধিক জেলাতেই অবিশ্বাস্য ছিল তার ধ্বংসলীলা। ১১০-১২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে হাওয়ার সঙ্গে ছিল তুমুল বৃষ্টি, যার ফলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যার। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সে সময়ের হিসেবে ২,২৩৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, বিনষ্ট হয় ৫০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা ছাড়াও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলী, এবং বর্ধমান, সঙ্গে ওড়িশার পারাদ্বীপ।
থানে (২০১১): তামিলনাড়ুর উত্তর উপকূলে কাড্ডালোর এবং পুদুচ্চেরির মাঝামাঝি ৩০ ডিসেম্বর পা রাখে এই ঘূর্ণিঝড়। খুব অল্পসময় স্থায়ী হয় এই ঝড়, কিন্তু ১৪০-১৬৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতিতে হাওয়া এবং মুষলধারে বৃষ্টির ফলে সেই অল্প সময়েই প্রাণ হারান ৪৮ জন মানুষ, সকলেই কাড্ডালোর এবং পুদুচ্চেরির বাসিন্দা। পড়শি রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশেও বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি ঘটায় থানে, তবে প্রাণহানি নয়।
ফেইলিন (২০১৩): ওড়িশার গোপালপুর উপকূলে ১২ অক্টোবর রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আছড়ে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়। আশঙ্কা করা হয়েছিল, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আন্দাজ ১.২ কোটি মানুষ। যার ফলে ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রেদেশে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় ৫.৫ লক্ষ মানুষকে। তা সত্ত্বেও বাঁচানো যায় নি ৩২৩ জনকে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আনুমানিক ২৬ হাজার কোটি টাকা।
ভার্দা (২০১৬): আরব সাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড় ভার্দার নিশানায় ছিল দক্ষিণ ভারত এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, এবং ১২ ডিসেম্বর তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ের কাছেই উপকূলে আছড়ে পড়ে এই ঝড়। হাওয়ার গতিবেগ ছিল ১৩০-১৫৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। ভার্দায় মৃত ৪৭ জনের মধ্যে অধিকাংশই তামিলনাড়ুর বাসিন্দা, যদিও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্ণাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশও। স্রেফ তামিলনাড়ুতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়ায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
অখি (২০১৭): আবারও একবার আরব সাগরের উপর সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, ফের নিশানায় দক্ষিণ ভারত, যদিও ঝড়ের আঘাত অনেকটাই নিজের দিকে টেনে নেয় শ্রীলঙ্কা। ৩০ নভেম্বরের এই ঝড়ে দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেরালার তিরুবনন্তপুরম এবং তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী জেলা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকায়। এরপর উত্তরপূর্ব দিকে ঘুরে যায় অখি, এগিয়ে যায় লাক্ষাদ্বীপ ও গুজরাটের দিকে। স্রেফ তামিলনাড়ুতেই অখির বলি হন ২০৩ জন মানুষ। শ্রীলঙ্কা এবং ভারত মিলিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা শেষমেশ দাঁড়ায় ৩১৮, এবং চিরতরে 'নিখোঁজ' থেকে যান কেরালার ১৪১ জন মৎস্যজীবী।
তিতলি (২০১৮): ১১ অক্টোবর ভোর পাঁচটা নাগাদ অন্ধ্রপ্রদেশের পালাসা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে আন্দামান সমুদ্র থেকে বঙ্গোপসাগরে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় তিতলি। তিতলির প্রভাবে অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাণ হারান আটজন, তবে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওড়িশা, যে রাজ্যে মৃতের সংখ্যা শেষমেশ দাঁড়ায় ৭৭, মূলত প্রবল বৃষ্টি এবং ধ্বসের কারণে। দক্ষিণবঙ্গেও নিজের উপস্থিতি বেশ জানান দেয় তিতলি, যদিও ততক্ষণে ঘূর্ণিঝড় পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে। ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
ফণী (২০১৯): 'ফণী আতঙ্ক' এখনও ভোলেন নি বাংলার মানুষ, যদিও শেষমেশ বাংলাকে একরকম রেহাই দিয়েই নিজের সমস্ত শক্তি ওড়িশা এবং বাংলাদেশের ওপর উজাড় করে দেয় বঙ্গোপসাগরের এই ঘূর্ণিঝড়। বস্তুত, ১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনের পর এত বড় ঝড় আর দেখে নি ওড়িশা। ৩ মে সকাল আটটা নাগাদ পুরীর কাছে ভূমিষ্ঠ হয় ফণী, ১৮৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা হাওয়ার বেগ এবং তুমুল বৃষ্টি সমেত। তার আগমন সংবাদ পেয়ে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানে আগেই সরিয়ে নিয়ে যান ওড়িশা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তা সত্ত্বেও ঝড়ের বলি হন অন্তত ৮৯ জন, দুই দেশ মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা।
বুলবুল (২০১৯): এই তো সবে মাস ছয়েক হলো। ৯ নভেম্বর, সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে আছড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। তার হাওয়ার গতিবেগ ছিল ১৩৫ কিমি প্রতি ঘণ্টা, সঙ্গে প্রবল বর্ষণ। দক্ষিণবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূলের উপর কয়েক ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায় বুলবুল, যার জেরে মৃত্যু হয় ৪১ জনের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান একাধিক মানুষ। কলকাতায় গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে যায় বহু রাস্তা। ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন