তেজপুর জেলে মায়ের সঙ্গে দেথা করতে যাওয়ার সময়ে একটা পলিথিন ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে ছাতু বা ছোলার ডাল নিয়ে যান বিশাল শাহ। "মা এগুলো ভালবাসে", বলছিলেন ২০ বছর বয়সী ছাত্র। ৪-এর দশকে ওঁদের পূর্বপূরুষ বিহার থেকে চলে এসেছিলেন আসামের চা বাগানে কাজ করতে।
আমিলা শাহের জেলবাস হয়ে গেল প্রায় দু মাস। বিশাল এখনও বুঝেই উঠতে পারেননি তাঁর ৩৯ বছর বয়সী মাকে কেন বাংলাদেশিদের জন্য তৈরি জেলে থাকতে হচ্ছে, যাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও যোগাযোগই নেই। আমিলা বাদে তাঁদের পরিবারের সবারই এনআরসি-তে নাম উঠেছে। বিশাল বললেন, "২০১৮ সালের জুন মাসে যখন বিদেশি ট্রাইবুনালের নোটিস এল, আমাদের গ্রামের প্রধান বললেন চিন্তার কিছু নেই। আমাদের কাছে কাগজপত্র আছে, আমরা বিহার থেকে এসেছি। দু দিনে সব মিটে যাবে, বলেছিলেন উনি।"
আরও পড়ুন, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল কী ভাবে কাজ করে
কোনও পরিসংখ্যান জনসমক্ষে না আনা হলেও সবারই বিশ্বাস এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছে হিন্দু ও মুসলিম বাংলাদেশিদের নাম। আমিলা শাহের মত ঘটনা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, এদিকে ক্রমে কাছে চলে আসছে ৩১ অগাস্ট, এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিন। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যখন এনআরসির চূডা়ন্ত খসড়া প্রকাশ হল, দেখা গেল উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ ও বিহার থেকে আসা বহু হিন্দিভাষী মানুষের নাম নেই। সারা আসাম ভোজপুরি পরিষদের কৈলাস গুপ্তা বলছিলেন, "আমরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এনআরসি-র রাজ্য কোঅর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করি, আমাদের সমস্যা কিছুটা মিটেওছিল। বিহার সরকার আমাদের নথি যাচাইয়ের কাজে এগিয়ে এসেছিল।"
২০১৮ সালের মে মাসে ৪১ বছরের দীনেশ প্রজাপতি এবং তাঁর স্ত্রী ৩৮ বছরের তারা দেবীকে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ওঁদের পূর্বপুরুষরা উত্তর প্রদেশ থেকে আসামে এসেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়, বলা হয় তিনসুকিয়ার ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে নাম নথুভুক্ত করতে।
আমিলার বাবা কেশবপ্রসাদ গুপ্তা এবং মা চন্দ্রাবতী গুপ্তা। দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে আমিলা চতুর্থ। কেশবের পরিবার ১৯৪৯ সালে আসামের শোণিতপুর জেলার বিশ্বনাথ চারিয়ালি গ্রামের প্রতাপগড় টি এস্টেটে এসেছিলেন। চন্দ্রাবতীর পরিবার আগে থেকেই শোণিতপুরে থাকতেন। ছোলা বিক্রেতা দুলারাম শাহের সঙ্গে ১৯৯২ সালে বিয়ে হয় আমিলার। বিয়ের পর তিনি চলে আসেন ঢোলাইবিল গ্রামে।
আরও পড়ুন, এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর ভারত কি সত্যিই কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে
আমিলার ভাই রমেশ গুপ্তা বিশ্বনাথ চরিয়ালিতে একটি পেট্রোল পাম্প চালান। তিনি জানালেন, "আমরা আমার বোনের ভোটার আইডি কার্ড, আমার বাবার ১৯৫১ সালের এনআরসি প্রমাণপত্র, হাসপাতালের রেকর্ড, স্কুলের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি।" দু সপ্তাহ আগে তিনি বিহার গিয়েছিলেন এক গ্রাম পঞ্চায়েতের শংসায়িত ফ্যামিলি ট্রি-র কপি আনতে।
আমিলার স্কুলের সার্টিফিকেট ও ভোটার আইডি কার্ডে নামের বানান ভুল ছিল। রমেশ জানালেন তাঁদের কাছে কী করে ভুল হয়েছিল, তার নথিও রয়েছে। তিনি বললেন, "স্কুলের সার্টিফিকেটে নাম রয়েছে উর্মিলা কানু আর ভোটার আইডি তে নাম রয়েছে আমিলা সাহু। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ভোটার আইডি কার্ডেই তো ভুল নাম রয়েছে, সে ভুল কেউই ঠিক করাতে যায় না।"
আমিলার আইনজীবী জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা গুয়াহাটি হাইকোর্টে গিয়েছেন। যে নির্দেশে আমিলা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি একজন বিদেশি এবং "বেআইনি ভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন", সেখানে বলা হয়েছে- "চন্দ্রাবতী বলেছেন আমিলা তাঁদের মেয়ে কিন্তু তাঁর মেয়ে কবে জন্মেছিল বা কবে ওঁর নিজের বিয়ে হয়েছিল, সে কথা তিনি মনে করতে পারছেন না।" বিশাল বললেন, আমিলা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। "আমরা জন্মদিন উদযাপন করি না। শুনানির সময়ে সম্ভবত নার্ভাস হয়ে গিয়ে ভুল বলেছেন।"
আরও পড়ুন, সামনে এনআরসি, ডুবলেও বাড়ি ছাড়তে চাইছেন না বন্যার্ত আসামবাসী