আগামী ৩১ অগাস্ট এনআরসি তালিকা প্রকাশিত হতে চলেছে। কিন্তু এনআরসি আপডেট প্রক্রিয়া আসামে নাগরিকত্ব চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ার যে বর্তমান ব্যবস্থাগুলি রয়েছে, সেগুলিকেও কাটা ছেড়ার মধ্যে ফেলেছে।
এনআরসি একটি স্বাধীন ও প্রযুক্তি পরিচালিত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা যাবে। এ প্রক্রিয়া চালিত হচ্ছে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু এনআরসির নিয়মানুসারে কোনও ব্যক্তি যদি বিদেশি ট্রাইবুনাল দ্বারা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন, কোনও ব্যক্তি যদি স্থানীয় নির্বাচনী আধিকারিক দ্বারা ডি ভোটার বলে চিহ্নিত হয়ে থাকেন অথবা যদি কোনও ব্যক্তি বা তাঁর উত্তরসূরীর যদি লিগ্যাসি সংক্রান্ত বিষয় বিদেশি ট্রাইবুনালে মুলতুবি থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এনআরসি আপডেট প্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখা হবে।
আরও পড়ুন: Assam NRC Final List Live Updates: আজ আসামের ভাগ্যপরীক্ষা, প্রকাশিত হচ্ছে এনআরসি
বিদেশি ট্রাইবুনাল একটি আধা বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা। ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনানুসারে কোনও ব্যক্তি বিদেশি কি না তা নিয়ে মতামত দেওয়ার অধিকারী এই ট্রাইবুনাল। যাঁদের সম্পর্কে সীমান্ত পুলিশ বা ডি ভোটার যাঁদের কথা উল্লেখ করেছে বিদেশি ট্রাইবুনাল তাঁদেরই নোটিস পাঠায়।
আরও পড়ুন: Assam NRC Final List 2019: আসাম এনআরসি: কীভাবে দেখবেন নামের তালিকা? জেনে নিন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশ, চূড়ান্ত এনআরসি থেকে যাঁদের নাম বাদ যাবে তাঁরা ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশি ট্রাইবুনালে আবেদন করতে পারবেন।
দুই সেনাকর্মীর উদাহরণ সম্প্রতি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে নজর কেড়েছে। এই দুটি উদাহরণ দেখিয়ে দেয় চূড়ান্ত এনআরসি-র তালিকা থেকে বাদ পড়া কীভাবে অন্য আইনগুলিকে ব্যবচ্ছেদ করেছে।
আরও পড়ুন, এনআরসি আসছে: এর পর কী হবে, সে প্রশ্নই কুরে কুরে খাচ্ছে আসামকে
মহম্মদ সানাউল্লা, ৫২
আসামের বাঙালি মুসলমান সানাউল্লা ৩০ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার পর কর্পস অফ ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়র্সের সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালের অগাস্টে তিনি অবসর নেন। মে মাসে তাঁকে বেআইনি বিদেশি বলে ঘোষণা করার পর তাঁকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর গৌহাটি হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেয়।
তাঁকে বেআইনি বিদেশি হিসেবে সন্দেহ করে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে ২০০৮-০৯ সালে আসাম পুলিশের সীমান্ত বিভাগ সানাউল্লার বিরুদ্ধে রেফারেন্স কেস দায়ের করে বিদেশি ট্রাইবুনালে। সেখানে তিনি নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হন। তিনি বলেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে জালিয়াতি হয়েছে। হাইকোর্টে তাঁর মামলা চললেও, যেহেতু তিনি ঘোষিত বিদেশি সে কারণে তিনি এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
সানাউল্লা বলেন, "বর্ডার পুলিশ যদি বিদেশি ট্রাইবুনালে মামলা না করত, তাহলে এনআরসি তে আমার নাম থাকত। আমার সমস্ত নথি ঠিকঠাক রয়েছে।"
রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে এক হলফনামায় এবং বিধানসভায় জাানিয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১,০৩,৭৬৪ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে বিদেশি ট্রাইবুনাল।
আরও পড়ুন, ঘনিয়ে আসছে এনআরসি প্রকাশের দিন, নামে যখন সব কিছু এসে যায়
মজিবর রহমান, ৫০
গোলাঘাট জেলার এক অসমিয়া মুসলমান মজিবর রহমান বিএসএফ জওয়ান। এখন তিনি পাঞ্জাবে কর্মরত। তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বেআইনি বিদেশি বলে ঘোষিত করা হয়। এ মাসের গোড়ায় তাঁর পরিবারের লোকেরা এ কথা জানতে পারার পর একজন আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। এর পরেই সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে বিষয়টি।
গোলাঘাটের এক পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন মজিবরের নাম স্থানীয় নির্বাচনপঞ্জী আধিকারিক বিদেশি ট্রাইবুনালে পাঠান। তিনি মজিবরকে সন্দেহভাজন বেআইনি বিদেশি বলে উল্লেখ করেন। যা পরীক্ষা করে সামান্ত পুলিশও ২০০৮ সালে একই কথা জানায়। ওই পুলিশ আধিকারিক বলেন, এটা একেবারেই ডি ভোটারের মামলা। গত বছর বিদেশি ট্রাইবুনাল নোটিস পাঠায়। এখন নির্বাচনপঞ্জী আধিকারিকরা আর কাউকে ডি ঘোষণা করতে পারেন না, কিন্তু পুরনো মামলার রেফারেন্স এখনও বিদেশি ট্রাইবুনালে যায় এবং সে অনুসারে নোটিসও জারি করা হয়।
১৯৯৭ সালে আসামে ডি ভোটার পদ্ধতি চালু করা হয়। ভেরিফিকেশনের সময়ে যাতে এঁরা নাগরিকত্ব প্রমাণ না করতে পারেন , সে জন্য ভোটার তালিকায় এঁদের চিহ্নিত করে রাথা হয়। বর্তমানে আসামে ১.২ লক্ষ ডি ভোটার রয়েছেন।
মজুবর রহমানের আইনজীবী নেকিবুর জামান বললেন, "রহমানের পরিবার এখানকার মুসলিম। ওঁদের সেই ১৯৩৫ সালের জমির পাট্টা রয়েছে। ওঁর এবং ওঁর স্ত্রীর নাম ৩১ অগাস্টের এনআরসি তালিকায় উঠবে না। আমরা হাইকোর্টে আপিল করছি।"
মজিবরকে বিদেশি ট্রাইবুনাল যে নির্দেশ জারি করেছে, তার আরও একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁর আইনজীবী- এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এক পাক্ষিক ভাবে। বিদেশি আইনের ৯ নং ধারায় বলা রয়েছে কোনও ব্যক্তি বিদেশি কি না তা প্রমাণ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ভারতীয় এবং তিনি যদি হাজির না হন তাহলে এক পাক্ষিক নির্দেশ জারি হতে পারে।
এর আগে এ বছরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জি কে রেড্ডি সংসদে বলেছেন আসামের বিদেশি ট্রাইবুনাল ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৩, ৯৫৯ জনকে একপাক্ষিকভাবে বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে।
বিদেশি নির্ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতি থাকার কারণেই য়ে অনেকের নাম চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ যাবে সে কথা স্বীকার করে নিয়ছেন রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা।
হোজাইয়ের বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব বলেছেন, "নির্বাচন কমিশন, বিদেশি ট্রাইবুনাল, এনআরসি, সবাই একসঙ্গে বিদেশি কে ঠিক করছে। যাদের যেনতেনপ্রকারে ডি ভোটার করে দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম এনআরসি-তে উঠবে না। কেউ নাগরিক হতে পারে, কেউ বিদেশি হতে পারে, ডি ভোটার আবার কী? বিদেশি ট্রাইবুনাল কতটা 'কর্তব্যপরায়ণ' সে আমরা বুঝে গেছি- বিশাল সংখ্যক মামলার রায় হয়েছে একপাক্ষিকভাবে, যা থেকে বোঝাই যাচ্ছে অভিযুক্ত নিজের কথা বলার সুযোগই পায়নি।"
অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আমসু) বলছে ২০১৩ সালে এ ব্যাপারে তারা সুপ্রিম কোর্টে প্রস্তাব দিয়েছিল। "বিদেশি ট্রাইবুনাল ও এনআরসি, এ দুইই যেহেতু আধাবিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা, আমরা বলেছিলাম যদি কেউ এনআরসিতে নিজেদের নথি দিয়ে তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেন তাহলে তাঁকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হোক। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব নাকচ করা হয়।"
এ বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট বলে যে বিদেশি ট্রাইবুনাল যদি কাউকে বেআইনি বিদেশি বলে চিহ্নিত করে তাহলে সে সিদ্ধান্ত এনআরসির অন্তর্ভুক্তি বা বহির্ভুক্তির উপর নির্ভরশীল থাকবে না।
ইতিমধ্যে সমান্তরাল প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে সাযুজ্য আনতে রাজ্য সরকার একটি কেন্দ্রীয় ডিজিট্যাল ডেটাবেস তৈরি করবে, যার নাম হবে ই ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। এতে বিদেশি ট্রাইবুনাল, সীমান্ত পুলিশ এবং এনআরসি থেকে থেকে পাওয়া সন্দেহভাজন বেআইনি বিদেশিদের রেকর্ড থাকবে সেখানে।
আসাম সরকারের আঘিকারিক আশুতোষ অগ্নিহোত্রী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, "ই ফরেনার্স ট্রাইবুনালের কাজ চলছে। এটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেস তৈরি থাকলে সকলেরই সুবিধা হবে।"
Read the Full Story in English