Advertisment

এনআরসি আসছে: এর পর কী হবে, সে প্রশ্নই কুরে কুরে খাচ্ছে আসামকে

৪৫ বছরের মনোতোষ ত্রিবেদী হিন্দু বাঙালি। তাঁর মা ও স্ত্রী-র নাম তালিকায় উঠবে কিনা সে নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Assam NRC

গুল বেগম (ছবি- অভিষেক সাহা)

বরখাল গ্রাম নেলির মরিগাঁও জেলায় অবস্থিত। গুয়াহাটি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে। ২৯ বছরের গুলবাহার বেগম এ গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গৃহবধূ। ৩১ অগাস্টের যে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে, তাতে তাঁর নাম থাকবে না। কারণ তাঁর বাবাকে বেআইনি বিদেশি বলে চিহ্নিত করেছে বিদেশি ট্রাইবুনাল। নেলির অসমিয়া ভাষী মুসলিম পরিবারের সদস্য তিনি। এঁরা ওই অঞ্চলের বহু পুরনো বাসিন্দা।

Advertisment

আরও পড়ুন, Assam NRC Final List Live Updates: আজ আসামের অগ্নিপরীক্ষা, একটু পরেই প্রকাশিত হচ্ছে এনআরসি

গুলবাহারদের গ্রামের অন্য দিকে, জাতীয় সড়কের অপর পারে যে উদ্বাস্তু কলোনি সেখানে বাস ৪৫ বছরের মনোতোষ ত্রিবেদীর। তিনি হিন্দু বাঙালি। তাঁর মা ও স্ত্রী-র নাম তালিকায় উঠবে কিনা সে নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। মনোতোষ একটা ছোট দোকান চালান, সে দোকানে পুজোআচ্চার জিনিসপত্র বিক্রি হয়। গুলবাহারের মত মনোতোষও জানেন না পরিবারের দুই মহিলার নাম যদি না ওঠে, তাহলে বিদেশি ট্রাইবুনালের আইনজীবীদের খরচ তিনি জোগাতে পারবেন কিনা।

আরও পড়ুন, Assam NRC Final List 2019: অসম এনআরসি: কীভাবে দেখবেন নামের তালিকা? জেনে নিন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আশ্বাস দিয়েছে যাঁদের নাম এনআরসি তালিকায় উঠবে না, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশিতে পরিণত হবেন না। তা সত্ত্বেও বহু মানুষ জানেন না তাঁরা ১ সেপ্টেম্বর কী করবেন। মন্ত্রক অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে তালিকাছুটরা যাতে এনআরসিভুক্ত হতে পারেন, সে জন্য বিদেশি ট্রাইবুনালের কাছে আবেদনের ব্যাপারে সবরকম সাহায্য করা হবে।

আরও পড়ুন, কর্মরত বিএসএফ জওয়ান আসামে বিদেশি ঘোষিত

গত ১৯ অগাস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি পর্যালোচনা বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল ও রাজ্যের শীর্ষ আমলারা। সেখানে রাজ্যের তরফ থেকে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। একটি সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে বিদেশি ট্রাইবুনাল কেবলমাত্র বিদেশি ঘোষণা করতে পারে। সোনওয়াল ইঙ্গিত দিয়েছেন এনআরসি আপডেট প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন উঠলে পরে সরকার কোনও আইন আনতে পারে। যদিও তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি যে এনআরসির ধাক্কা সামলাতে সে আইনে কী থাকবে।

গুলবাহারের বাবা গুল মহম্মদের বয়স ৬৯। তিনি আগে দিন মজুরের কাজ করতেন। ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে তাঁর নাম ছিল। তিনি তখন এক বছরের শিশু। ২০০৯ সালে বিদেশি ট্রাইবুনাল তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করেছে। গত ১৮ মাস ধরে তিনি ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন। এনআরসি আইনানুসারে ঘোষিত বিদেশি ও তাঁদের উত্তরসূরীরা এনআরসি তালিকায় থাকবেন না।

আরও পড়ুন, এনআরসি আসছে, ভয়ে কাঁপছে বিজেপি

গুলবাহারে স্বামী গ্রামের একজন ড্রাইভার। গুলবাহারের মা জুনাকি বেগম হাইওয়ের ধারে একটি ছোট পানের দোকান চালান। গুলবাহারের দিদির বিয়ে হয়েছে এক মেকানিকের সঙ্গে। তাঁদের আর্থিক দুর্দশা এতটাই যে গুল মহম্মদকে আটক রাখার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদনও করতে পারেননি তাঁরা।

"আমি জানি না বিষয়টা এত জট পাকানো কেন। আমার বাবার নাম ১৯৫১ সালের এনআরসি-তে ছিল। মোরিগাঁও জেলার বিদেশি ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছে তিনি বিদেশি। আসেল ওরা রাজ্য সরকার যে অভিযোগ এনেছিল তাতেই সায় দিয়েছে। রাজ্যের অভিযোগ ছিল আমার বাবা ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশে জন্মেছেন, ১৯৭১ সালের পর বেআইনিভাবে আসামে এসেছেন। আমরা খুব চিন্তায় আছি। আমার ও আমার বোনের নাম ওঠেনি। এর পর কী করব জানি না। বাবার মত আমাদেরও ক্যাম্পে পাঠাবে! আমরা এত গরিব যে উকিল দিতে পারব না, কোর্টেও যেতে পারব না।"

৭২ বছরের অঞ্জলি। মনোতোষ ত্রিবেদীর মা। তাঁর ১৯৫৫ সালের রিফিউজি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন এনআরসি আধিকারিকরা। মনোতোষের স্ত্রী সন্তোষীর বাবার ১৯৭১ সালের ম্যাট্রিকুলেশনের সার্টিফিকেট অবশ্য একেবারে নাকচ হয়ে যায়নি।  সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আধিকারিকরা। ফলে তিনি একটু আশা করছেন, নাম থাকলেও থাকতে পারে। খসড়া এনআরসি তালিকায় অবশ্য দুই শাশুড়ি-বৌমা কারোরই নাম ছিল না।

আরও পড়ুন, ভারতীয় নাগরিক কারা? কীভাবে তা স্থির করা হয়?

মনোতোষ অবশ্য বলছেন চূড়ান্ত এনআরসিতে দুজনের কারোরই নাম থাকবে না। "এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের কী করতে হবে, সে নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা উচিত। যাদের নাম বাদ যাবে তাদের নিয়ে সরকার কী করবে! আমরা হচ্ছি সেই ভারতীয় যারা এখনকার বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য এখানে এসেছি। কী হচ্ছে সে নিয়ে কিছুই স্পষ্ট নয়।"

৪৮ বছরের অজিত তালুকদার আরেক হিন্দু বাঙালি। তিনি মনোতোষ ত্রিবেদীর বন্ধুও বটে। অজিতের নাম খসড়া এনআরসি-তে ওঠেনি। তাঁর ১৫, ১৩ ও ৫ বছরের তিন সন্তানের নাম বাদ পড়েছে ২৬ জুনের প্রকাশিত অতিরিক্ত তালিকাছুটের লিস্টে। অজিতের অনেক প্রশ্ন। " আমার বাবার কাগজপত্রে ভূষণ তালুকদার ও দাস দুরকম পদবী ছিল। ফলে সমস্যা হয়েছে। আমার ও ছেলেমেয়েদের নাম সম্ভবত তালিকায় উঠবে না। তাহলে আমাকে কি ছেলে মেয়ে নিয়ে বিদেশি ট্রাইবুনালে লাইন দিতে হবে? ওরা কি আমাদের আটকে রাখবে?"

১৯৮৩ সালে নেলি হত্যাকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ২০০০ জনেরও বেশি। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন তে বাঙালি মুসলমান। সে ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন আব্দুল হামিদের বাবা। আহত হয়েছিলেন তাঁর মা ও বোন। আব্দুল হামিদের বয়স এখন ৭০। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মরিগাঁওয়ের বিদেশি ট্রাইবুনালে মামলা নথিবদ্ধ হয়েছিল। সে মামলা জিতেছেন আব্দুল হামিদরা। কিন্তু তাঁর নাম খসড়া তালিকায় নেই।

"আমি একটা ইটভাটায় কাজ করি। ভাটা মালিকের কাছ থেকে ধার নিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করে বিদেশি ট্রাইবুনালে মামলা লড়েছি। এখন কাজ করছি সে টাকা শোধ দেবার জন্য। ৩১ অগাস্টের তালিকায় যদি আমার পরিবারের লোকের নাম না ওঠে, আমি জানি না তারপর কী করব।" বলছেন হামিদ।

Read the Full Story in English

Assam nrc
Advertisment