বিজু জনতা দলের সাংসদ তথা ওড়িশার শিল্পপতি বৈজয়ন্ত জয় পাণ্ডা, তাঁর স্ত্রী ও সঙ্গীসাথীদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি এবং কর ফাঁকির অভিযোগ জমা পড়েছে আয়কর দফতরে।
জানুয়ারি মাসে জমা পড়া ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, জয় পাণ্ডা, তাঁর স্ত্রী জগগি মঙ্গত পাণ্ডা এবং "তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী" মঞ্জুলা দেবী শ্রফ বিভিন্ন আইন ভেঙে "ভারতের বাইরের অজ্ঞাত সূত্র" থেকে শেল কোম্পানির মাধ্যমে অন্তত ১৭.৭২ কোটি টাকা দেশে আনিয়েছেন এবং "জয় ও তাঁর স্ত্রীর নামে সে সব বিদেশি বিনিয়োগের শেয়ার নামমাত্র দামে হস্তগত করা হয়েছে"।
আরও পড়ুন: সারদা কেলেঙ্কারি ও তৃণমূল সংযোগ
বৈজয়ন্ত পাণ্ডা এবং মঞ্জুলা দেবী শ্রফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এ ব্যাপারে কোনোরকম দুর্নীতির কথা অস্বীকার করেছেন। এক ই-মেলে বৈজয়ন্ত পাণ্ডা জানিয়েছেন, ''যেসব লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলি দু'দশক আগের। আমার জ্ঞানমতে, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।" শ্রফ বলেছেন, "আমার কাছে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি রয়েছে মাত্র, যে সব লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলির উপর আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, এবং এই লেনদেন থেকে আমি লাভবানও হই নি।"
এখানে যেসব কোম্পানিগুলির কথা বলা হচ্ছে, সেই ফিনলে কর্পোরেশন, মেসিনা কর্পোরেশন লিমিটেড এবং পিকিকা লিমিটেডের নাম উঠেছিল ২০১৬ সালে তদন্তমূলক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফাঁস করা বাহামা কেলেঙ্কারিতেও।
বাহামা রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজের নথিতে দেখা যাচ্ছে, ফিনলে, মেসিনা এবং পিকাকা যথাক্রমে ১৯৯৩ সালের জুন, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি এবং ২০০৩ সালের মার্চে নথিবদ্ধ হয়েছিল। এই তিনটি কোম্পানিরই ঠিকানা একই ছিল।
রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৪ সালের জুলাই মাস থেকে মঞ্জুলা দেবী শ্রফ ফিনলের পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি পেয়েছেন। ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি থেকে মেসিনার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি রয়েছে তাঁর। ওড়িশার পূর্বতন রাজবংশের উত্তরসূরী মঞ্জুলা দেবী শ্রফ কারোলেক্স গ্রুপের সিইও। এই গ্রুপটি গুজরাটে স্কুল চালায়। এ ছাড়াও তিনি কিষাণগড় এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন প্রাইভেট লিমিটেড এবং ওড়িশা টেলিভিশন লিমিটেডের বোর্ডে রয়েছেন। বোর্ডে রয়েছেন জগগি মঙ্গত পাণ্ডাও।
আরও পড়ুন, বিস্ফোরক নথি! “৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি করেছেন মোদী”
এ ছাড়াও ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্থানীয় কেবল এবং ব্রডব্যান্ড পরিষেবাদায়ী সংস্থা ওর্টেল কমিউনিকেশন লিমিটেডের বোর্ডে ছিলেন মঞ্জুলা দেবী শ্রফ। ওই বোর্ডে ছিলেন বৈজয়ন্ত পাণ্ডা এবং জগগি মঙ্গত পাণ্ডাও। ওর্টেল কমিউনিকেশন এখন দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়ায় আছে।
১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ফিনলে, মেসিনা এবং পিকাকা - বাহামার এই তিনটি কোম্পানি সরাসরি এবং ভারতে তাদের অধীনস্থ কোম্পানি এম এস টেলিকম লিমিটেড ও ক্যারোলেক্স হোল্ডিং প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে ওর্টেলে ১৭.৭২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। মঞ্জুলা দেবী শ্রফ সে সময়ে এম এস টেলিকম এবং ক্যারোলেক্স, এই দুই কোম্পানিরই ডিরেক্টর ছিলেন।
বাহামার তিনটি কোম্পানি এবং তাদের অধীনস্থ দুই ভারতীয় কোম্পানির বিনিয়োগ করা ৯.৪৬ কোটি টাকার ইকুইটি শেয়ার এক ষষ্ঠাংশ দামে অর্থাৎ ১.৬৮ কোটি টাকায় নিজেদের দখলে নিয়ে নেন পাণ্ডা পরিবার। এর জন্য তাঁরা কাজে লাগান তাঁদের পারিবারিক কোম্পানি পাণ্ডা ইনভেস্টমেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড এবং মেট্রো স্কাইনেট লিমিটেডকে।
এরপর, ফিনলের হাতে থাকা সমস্ত প্রেফারেন্স শেয়ার ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বরাদ্দ করা হয় ওড়িশা টেলিভিশন লিমিটেডকে, যার ডিরেক্টর ছিলেন মঞ্জুলা দেবী শ্রফ এবং জগগি মঙ্গত পাণ্ডা।
পিকিকা ২০১১ সালের জুলাই মাসে অদৃশ্য হয়ে যায়। মেসিনা একই পথ গ্রহণ করে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০১৮ সালের মার্চে গুটিয়ে যায় ফিনলে। তা সত্ত্বেও কোম্পানির ৯৬.১৩ শতাংশ শেয়ারহোল্ডিং এবং এম এস টেলিকমকে দেওয়া ২.০৩ কোটি টাকার অগ্রিম ঋণের হিসেব, এম এস টেলিকমের ২০১৭-১৮ সালের বার্ষিক রিটার্নে দেখানো হয়েছে।
লেনদেনের খুঁটিনাটি
ওর্টেল কমিউনিকেশনস লিমিটেড কেবল টিভির ব্যবসায়ে ঢোকে ১৯৯৫ সালে। সেবিতে ওর্টেলের দেওয়া তথ্য অনুসারে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ফিনলে আট বারে মোট ৯.৬৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল।
ক্যারোলেক্স হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডে ফিনলে আরও ৪.৩৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এখানে ১৯৯৫ সাল থেকে ডিরেক্টর পদে আসীন মঞ্জুলা। এর পরিবর্তে ক্যারোলেক্স ওর্টেলে বিনিয়োগ করে ২.৮২ কোটি টাকা।
ফিনলে এম এস টেলিকম ইনভেস্টমেন্টস প্রাইভেট লিমিটেডে আরও ৫৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে এবং ২.০৩ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। মঞ্জুলা দেবী এই কোম্পানির ডিরেক্টর এবং শেয়ারহোল্ডার ছিলেন। এর বিনিময়ে এম এস টেলিকম ওর্টেলে ৫৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে।
মেসিনা ক্যারোলেক্সে ৫০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে, যারা ৩৯.৪৫ লক্ষ টাকার ওর্টেল শেয়ার কিনে নেয় এলং পিকিকা সরাসরি ওর্টেলের ৬২.৫ লক্ষ টাকার শেয়ার কিনে নেয়।
সব মিলিয়ে বাহামার তিনটি শেল কোম্পানি পাণ্ডা এবং শ্রফদের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিতে মোট ১৭.৭২ কোটি টাকা এনে দেয় বলে অভিযোগ।
বৈজয়ন্ত পাণ্ডার উত্তর
"আপনাদের ই-মেলে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে আমি শকড এবং আতঙ্কিত হলেও, বিস্মিত নই। যদিও কারা এ অভিযোগ করেছে, সে ব্যাপারে আপনারা কোনও ইঙ্গিত করেন নি, তবে প্রতিবার ভোটের আগে এ এক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ধরে আমি এসব অভিযোগ শুনে আসছি এবং প্রতিবাদ করে আসছি, আমার ওয়েবসাইটে এ ব্যাপারে একটা পোস্টও দেওয়া আছে।
"এবারেও আমি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করছি। আমি এমন একটা পরিবারের সদস্য, যাঁদের ৬০ বছর ধরে ব্যবসা চালানো এবং ব্যবসা গড়ে তোলার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। সারা ভারত জুড়ে আমরা হাজার হাজার মানুষকে চাকরি দিয়েছি। আমাদের লেনদেন হয় সারা পৃথিবীতে। আপনারা যে কম্পানির কথা বলছেন, সেই ওর্টেলের ২৫ বছরের ইতিহাস রয়েছে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডর হিসেবে সরকারের কাছ থেকে প্রথম লাইসেন্স পাওয়া কোম্পানিগুলির মধ্যে এটি একটি।
"আপনারা যেসব লেনদেনের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে কিছু লেনদেন দু'দশকেরও বেশি পুরনো। আমার জ্ঞানমতে এগুলির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছিল। শেয়ারের দামের ব্যাপারে আপনাদের প্রশ্নের উত্তরে বলার, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম ওঠাপড়া করেই। পাবলিক হওয়ার পরেও এই কোম্পানির শেয়ারের দাম যে যথেষ্ট ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে, তা আপনারা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। বিশেষ করে গত তিন বছরে টেলিকম ক্ষেত্রের রেকর্ড দেখলে এই ওঠানামার বিষয়ে আপনারা এ ব্যাপারে বিশদে জানতে পারবেন।"
Read the Full Story in English