এরপর কোন সেতুর পালা? মহানগরে এটাই এখন সবচেয়ে বড় চর্চার বিষয়। ২০১৩ সালে উল্টোডাঙ্গায় সেতু ভেঙে ট্রাক খালে পড়ে গিয়েছিল। তারপর ২০১৬ সালে ভেঙে পড়ে পোস্তার বিবেকানন্দ উড়ালপুল। আর মঙ্গলবার হুড়মুড়িয়ে ভাঙল মাঝেরহাট সেতু। প্রশ্ন, শহরের আর ঠিক কোন সেতু এতটা বিপজ্জনক? মুখ্য়মন্ত্রীর সেতু পরিদর্শনের কয়েকঘণ্টা আগে রাজ্য়ের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নয়, "বয়সের ভারে" ভেঙে গিয়েছে মাঝেরহাট সেতু। সেতুগুলির স্বাস্থ্য় পরীক্ষা কারা করে? কী কী পদ্ধতি মেনে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯৬৫ সালের তৈরি সেতু এখন কী একইভাবে সক্ষম রয়েছে? ব্রিজের ওপর লোড অনেক বেড়ে গিয়েছে। এমন নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। অবিলম্বে শহরের বাকি উড়ালপুলের স্বাস্থ্য়পরীক্ষা সঠিক ভাবে করা উচিত বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।
কিন্তু স্বাস্থ্যপরীক্ষা হলেই বা কী? ছমাস আগে সেতুর ফিট সার্টিফিকেট কী দেখে দেওয়া হয়েছিল? বিশেষজ্ঞদের মতে, সেতু যখন তৈরি হয়েছিল, তার লোড ক্য়াপাসিটি ছিল ১০-১৫ টন। এখন লোড বেড়ে হয়ে গিয়েছে প্রায় ৩০-৩৫ টন। সেসময় যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করত তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। মাঝেরহাট সেতু এখন বেহালা, বজবজ-সহ তারাতলা এবং আলিপুরের মূল সংযোগস্থল। অর্থাৎ কলকাতা থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার দিকে যাতায়াতের অন্য়তম মূল সেতু। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেতুর ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। পাশাপাশি, ভূমিকম্পর ফলেও সেতুর গঠনের ক্ষতি হতে পারে। এই সেতুটি পুরনো হয়ে যাওয়ার ফলে ক্রমাগত পিচের প্রলেপ দেওয়ায় আরও বেড়েছে এর ওপর ওজন। এমনকী সেতুটির নানা দিকে বট-অশ্বত্থ গাছ গজিয়ে গিয়েছে। তাহলে এই দুর্ঘটনার দায় কার?
আরও পড়ুন: সেতু রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির চারটি ধারায় মামলা করছে পুলিশ
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, ২০১৬ সালেই RITES (Rail India Technical and Economic Service) সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে শহরের অনেকগুলি সেতুর অবস্থা বিপজ্জনক, যার মধ্যে একটি ছিল মাঝেরহাট সেতুও। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি। RITES-এর এক আধিকারিক জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার নড়বড়ে মাঝেরহাট ব্রিজের সংস্কারে উদ্যোগী হলেও তা লাল ফিতের ঘেরাটোপে আটকা পড়ে রয়ে যায়।
মাঝেরহাটের একটু দূরেই রয়েছে ব্রেসব্রিজ। কসবা সেতুর রক্ষনাবেক্ষণ এর আগে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখতে হয়েছে। সেতুর পিলারের গোড়ায় ইঁদুর বড় বড় গর্ত করে বিপদ বাড়িয়েছিল। সময়মত নজরে না পড়লে, বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারত। ব্রেস ব্রিজ, কসবার মত ঢাকুরিয়া ফ্লাইওভার, অরবিন্দ সেতু, শিয়ালদা উড়ালপুল, এমন অনেক সেতু রয়েছে এই শহরে, যেগুলির নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। একাধিক সেতু বয়সের ভারে জীর্ণ। এর পরেও কি দায় এড়াবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর?
এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে তাই। বুধবারও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম কিন্তু দুর্ঘটনার কোনও দায় তিনি নেননি। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ফিরহাদ বলেন, "RITES যে কথা বলেছে তা ঠিক নয়। তারা বলেছে মেট্রোর কম্পনে কিছু ক্ষতি হয়নি। এটা ভুল। মেট্রোর কম্পনে সেতুর ক্ষতি হয়েছে। আর রক্ষনাবেক্ষণ হয়নি বলেছে, এটাও মিথ্য়া। বয়সের ভারে সেতুটি পড়ে গিয়েছে।" অন্যদিকে এদিন RITES সেতু পর্যবেক্ষণ করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, মেট্রোর কাজের জন্য় কোনও ক্ষতি হয়নি মাঝেরহাট সেতুর। ফরেন্সিক দল এদিন নমুনা সংগ্রহ করেছে। তারা দেখবে প্রকৃত কী কারণে এই দুর্ঘটনা।
মঙ্গলবারের দুর্ঘটনার পর থেকে শিয়ালদা মাঝেরহাট রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। শিয়ালদা থেকে নিউ আলিপুর ও মাঝেরহাট থেকে বজবজ ট্রেন চলাচল করছে। অন্য় দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পরিবহণ দফতর কিছু বাড়তি বাসের ব্য়বস্থা করেছে। তারাতলা থেকে বজবজ এবং টালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ থেকে বেহালা চৌরাস্তা, বেহালা থেকে ডায়মন্ডহারবার, দোস্তিপুর। অাবার নিউ আলিপুর থেকে বেহালা চৌরাস্তা। এভাবে যাত্রী হয়রানি রুখতে কিছুটা হলেও উদ্য়োগ নিয়েছে পুরসভা। কিন্তু সরাসরি মাঝেরহাট হয়ে বেহালা যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ চরম অসুবিধার মধ্য়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা এখনই বলতে পারছেন না কেউই।
মুখ্য়মন্ত্রীর নির্দেশে ঘটনার তদন্ত করবেন রাজ্য়ের মুখ্য়সচিব মলয় দে। ইতিমধ্য়ে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। কিন্তু ছমাস আগের ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া ব্রিজ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল, এর ব্য়াখ্য়া কে দেবে? আজ সন্ধ্য়ায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। ইতিমধ্য়ে মৃত এবং আহতদের ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে সরকার। তাহলে কি এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে? তদন্ত হবে, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা হবে, এবং শহরবাসী অপেক্ষা করবেন, আবার কবে একটা বিবেকানন্দ উড়ালপুল, মাঝেরহাট ব্রিজের মত ঘটনা ঘটবে?
আগামীকাল নবান্নে পিডবলুডি (PWD), কেএমডিএ (KMDA) এবং পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষার রিপোর্ট তলব করবেন তিনি। ভালো হলেই ভালো।