হাথরাসের ঘটনায় মুখ পুড়েছে যোগী সরকারের। প্রতিনিয়ত ধেয়ে আসছে সমালোচনার ঝড়। দলিত তরুণীর গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সরকার যাই পদক্ষেপ করুক না কেন তা প্রতিবাদের আগুনে জল ঢালতে ব্যর্থ। সংবাদ মাধ্যম থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি- নির্যাতিতা মৃতার পরিবারের অভিযোগ শুনতে গ্রামে ঢুকতে মরিয়া। আর তাতেই আগুনে ঘৃতাহুতির ভয় পাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। কার্যত দিশাহারা যোগী প্রশাসন। তাই গণধর্ষিতার গ্রামকে প্রায় 'দুর্গে' পরিণত করে ফেলেছে যোগীর পুলিশ। তিনশ পুলিশ কর্মী, সতেরো পুলিশ ভ্যান ও গ্রামে প্রবেশের মুখে পরতে পরতে পাঁচটি ব্যারিকেডে হাথরাস যেন 'বদ্ধভূমি'।
কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে কই? গণধর্ষিতার পরিবারের কথা মাঝে মধ্যেই ভিডিও আকারে সামনে এসে যাচ্ছে। যা মিনিটে ভাইরাল। তাই যোগী প্রশাসনের কড়া নজরে এখন মৃতা তরুণীর পরিবার। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মৃতার পরিবারের তরফে বলা হয়েছে, গত দু'দিন ধরে পুলিশ তাঁদের কার্যত গৃহবন্দি করেছে। তাঁদের ফোনেও নজরদারি চলছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের এক সদস্যের কথায়, 'জেলা শাসক এসে বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তাহলে তোমাদের কথার ভিডিও বাইরে যাচ্ছে কীভাবে?' টথস্থ পরিবার। গণধর্ষিতার ভাই ফোন ধরেই তড়িঘড়ি বললেন, 'মনে হচ্ছে প্রশাসন আমাদের ফোনে নজরদারি করছে।'
হাথরাসজুড়ে এখন খাঁকি উর্দির দাপাদাপি। যোগীর নির্দেশে পুলিশ 'রাজধর্ম' পালনে ব্যস্ত। গ্রামে প্রবেশের প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে প্রথম ব্যারিডে তৈরি করা হয়েছে। এখানেই শুক্রবার পুলিশ তৃণমূলের প্রতিনিধি দলকে আটকেছিল। কেন এই বাধা? সদুত্তর দিতে ব্যর্থ যোগীর পুলিশ। শুক্রবার দুপুর প্রায় ১২.২০ নাগাদ পুলিশের সঙ্গে তৃণূমূলের প্রতিনিধি দলের বচসা, ধস্তাধস্তি শুরু হয়। বচসায় জড়িয়ে পড়েন জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্রেম প্রকাশ মীনা। এক ফাঁকে মাটিতে পড়ে যান তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন।
বৃহস্পতিবার এখানেই রাহুল-প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সহ কংগ্রেস প্রতিনিধি দলকেও নির্যাতিতা মৃতার গ্রামে প্রবেশের মুখে আটকানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন- হাথরাসকাণ্ডে সাসপেন্ড পুলিশ সুপার-সহ ৫ অফিসার, পুলিশের ‘সন্দেহজনক’ পদক্ষেপ নিয়ে সরব উমা
যোগী প্রশাসনের এক পুলিশ কর্তা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, 'উপর তলা থেকে নির্দেশ রয়েছে সাংবাদ মাধ্যমের কোনও কর্মী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, এমনকী স্থানীয়দেরও যেন গ্রামের ঢুকতে দেওয়া না হয়। গ্রামের মধ্যেই হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে রোগী নিয়ে যেতে গেলেও সমস্যা হচ্ছে। তবে দুধের ভ্যান ছুকতে দেওয়া হচ্ছে।'
শুক্রবার রাতে হাথরাসের ঘটনায় পুলিশ সুপার-সহ ৫ আধিকারিককে সাসপেন্ড করেছে যোগী সরকার। গণধর্ষণ ও নির্মম অত্য়াচারে দলিত তরুণীর মৃত্য়ুর ঘটনায় সাসপেন্ড করা হয়েছে হাথরাসের পুলিশ সুপার বিক্রান্ত বীর, সার্কেল অফিসার রাম শবদ, ইন্সপেক্টর দীনেশ মিনা, সাব ইন্সপেক্টর জগবীর সিং ও হেড কনস্টেবলকে। তার আগে আলিগড় রেঞ্জের আইজি পিযূস মোরদিয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, 'সিট গ্রামে রয়েছে। তদন্ত করছে। সিটের সদস্যরা গ্রাম ছাড়লেই সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।'
খাঁকি উর্দি, হাতে লাঠি, মাথায় হেলমেট- অচেনা লোক দেখলেই সজাগ পুলিশ, মাছি গলবারও সুযোগ নেই। হাথরাসের সব থানা ছাড়ও দুর্গ তৈরির জন্য মথুরা, আগ্রা, আলিগড়, কাশগঞ্জ, ইটাহ থেকেও বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ১২ ঘন্টা করে ডিউটি করছেন তাঁরা।
হাথরাসের জেলাশাসক প্রবীণ কুমার লক্ষকার নির্যাতিতার বাবাকে কার্যত হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। বলেছিলেন, 'মিডিয়া এখানে কত দিন থাকবে! থাকব তো আমরাই।' এখানেই শেষ নয়, পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বয়ান বদলেরও কথা বলেন। নির্যাতিতার ভাইয়ের অভিযোগ, জেলাশাসক তাঁদের বলেছিিলেন, 'বয়ান বদল করলেই প্রশাসনের আচরণও বদলে যাবে।' অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেন জেলাশাসক। লক্ষকার বলেছেন, 'ভয় থেকে মুক্ত করতেই পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম।'
গণঘর্ষিতার পরিবারের দাবি, সিট, জেলা প্রসাসনের কর্মী ও পুলিশ ছাড়া গ্রামে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন- ‘নারী নির্যাতনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে’, হাথরাসকাণ্ডের আবহে কড়া হুঁশিয়ারি যোগীর
শুক্রবার দুপুর থেকে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের পক্ষ থেকে মৃত্রা ভাই, বাবা, কাকাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাঁরা ধরেননি। পরে এক জন ফোন ধরেন ও নিজেকে নির্যাতিতার ভাই বলে দাবি করেছেন। এক মিনিটেরও কম সময়ের কথায় সে জানায়, 'বাড়ির মধ্যে পুলিশ রয়েছে। তারা ফোনে কথা বলতে নিষেধ করছে। বাড়ির বাইরে কাউকে বেরতে দিচ্ছে না।'
বিকেল চারটের সময় নির্যাতিতার এক কাকা-কাকিমা গ্রামে প্রবেশ করতে গেলে তাঁদেরও পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়। সেই সময় তাঁরা বলেন, ফোনে পরিবারের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্বেগ বাড়ছে। তাই বাড়ি যেতে চান তাঁরা।
গ্রামে রয়েছে প্রায় আড়াশ পুলিশ কর্মী। মোতায়েন রয়েছে প্রভিনশিয়াল আর্মড কনস্টাব্যুলারির (পিএসি) ৪৮ জন কর্মীও। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিনিধিদের নজরে পড়েছে, হাথরাসজুড়ে রয়েছে পুলিশের ১২ গাড়ি, ৩ ট্রাক, ২টি পিএসি-এর বাস ও ২টি দমকলের গাড়ি। মাঝে মধ্যেই অন্যান্য গাড়িতেও আসা-যাওয়া করছে পুলিশ।
হাথরাসে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। দোকানপাট বন্ধ। চলছে পুলিশ পেট্রলিং। তা ছাড়া খাঁ খাঁ করছে রাস্তা। খবর চাপতে মরিয়া প্রশাসন।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন