সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমারের ওপর যতই চাপ বাড়াক সিবিআই, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে এই একই বিষয় সংক্রান্ত মামলা, যা দায়ের করা হয় ২০১৫ সালে, ঠাণ্ডা হয়ে যায় কয়েক মাসের মধ্যেই। ঠিক একইভাবে পরিত্রাণ পেয়ে যান আসামের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। সারদা কাণ্ডে টাকা নেওয়ার অভিযোগ, সিবিআইয়ের সমন, বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার হানা, সব সত্ত্বেও কোনো চার্জশিটে নাম ওঠে নি তাঁর।
দুজনেই তদন্ত চলাকালীন যোগ দেন বিজেপিতে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই সারদা কাণ্ডের তদন্ত শুরু করে ২০১৪ সালে, এবং মুকুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ৩০ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে। মুকুলের ক্ষেত্রে তদন্তের কেন্দ্রে ছিল সারদার মিডিয়া সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা, এবং সারদার চেয়ারম্যান সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। মুকুলের ড্রাইভারের বয়ান ছিল সিবিআইয়ের কাছে, যাতে বিশদে বলা ছিল কীভাবে সুদীপ্ত সেনকে কলকাতা ছেড়ে পালাতে সাহায্য করেন মুকুল।
আরও পড়ুন: দিল্লি গেলেন রাজীব কুমারের বাড়িতে হানা দেওয়া সিবিআই দলের প্রধান
তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের অভিযোগের ভিত্তিতে মুকুলকে ২০১৫ সালে ডেকে পাঠায় সিবিআই। কুণাল নিজে গ্রেফতার হন ২০১৩ সালে। কর্মচারীদের বেতন না দেওয়া সংক্রান্ত এক মামলায় অভিযোগ দায়ের করে সারদা গ্রুপের একটি সংস্থা, যার জেরে প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ করা, এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে কুণালের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারির কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ঠিক এক ডজন নাম উগরে দিয়েছিলেন তিনি। সেই বারোটি নামের একটি ছিল মুকুল রায়।
ইতিমধ্যে বিজেপির সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন মুকুল, সেই ২০১৫ থেকেই। যার পরিণতি স্বরূপ ৩ নভেম্বর, ২০১৭ সালে শেষমেশ বিজেপিতে যোগ দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা বিশ্বস্ত সেনাপতি।
শর্মার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। তাঁকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করে ২৬ নভেম্বর, ২০১৪ সালে। এর দুমাস আগে গৌহাটিতে তাঁর বাড়িতে এবং তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে রেইড করে সিবিআই। শর্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি প্রতি মাসে সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পেতেন, আসামে সারদার ব্যবসা চালাতে সাহায্য করার বিনিময়ে। গ্রেফতার হওয়ার পর সুদীপ্ত অভিযোগ করেন, আসামের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, আমলা, এবং মিডিয়া কর্তারা "শুষে নিয়েছেন" তাঁকে। সিবিআই-কে লেখা এক চিঠিতে এইসব ব্যক্তিদের নামও নেন তিনি।
The frivolous & baseless campaign by @MamataOfficial Didi against me is very painful. I am not fortunate enough like your Police Commissioner. I've joined the investigations and offered my full cooperation as a witness. And all this happened much much before I joined @BJP4India
— Himanta Biswa Sarma (@himantabiswa) February 5, 2019
কিন্তু তাদের দায়ের করা একটিও চার্জশিটে শর্মার নাম করে নি সিবিআই। বিজেপিতে ২৮ অগাস্ট, ২০১৫ সালে যোগ দেন শর্মা। তাঁকে এখন পর্যন্ত কোনো চিট ফান্ড সংক্রান্ত মামলায় তলব করে নি সিবিআই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মুকুল বলেছেন, "আমাকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছিল ২০১৫ সালে। আর আমি বিজেপিতে যোগ দিয়েছি ২০১৭-য়। সিবিআই-এর থেকে সুবিধে নেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কী করে?" শর্মার সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি, বহুবার ফোন এবং মেসেজ করা সত্ত্বেও।
রাজীব কুমার কলকাতার পুলিশ কমিশনার হিসাবে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেওয়ার দেড় বছর পরে, ২০১৭-র অক্টোবরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রথম সমন পাঠায় সিবিআই। এরপর ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ১৬০ ধারায় আরও চারবার রাজীবকে নোটিস পাঠায় সিবিআই। শেষ নোটিশটি পাঠানো হয় গত বছরের ডিসেম্বরের ৮ তারিখ।
আরও পড়ুন: ‘বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অফিসার’ রাজীবের পাশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা
প্রথম নোটিশটি পাওয়ার পর ২০১৭-র ২৭ অক্টোবর সিবিআই-এর তৎকালীন ডিরেক্টর অলোক বর্মাকে চিঠি লিখে রাজীব জানান, "এভাবে তথ্য যাচাই না করে বা ন্যূনতম প্রাথমিক যোগাযোগের চেষ্টা না করে যদি পুলিশ কমিশনারদের ১৬০ ধারায় নোটিশ পাঠানো হয়, সেটা 'প্যান্ডোরার বাক্স' খোলারই সামিল।”
সারদা চিট ফান্ড মামলায় ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার যে 'সিট' (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম' তৈরি করেছিল, ১৯৮৯ ব্যাচের আইপিএস অফিসার রাজীব কুমার তার নেতৃত্বে ছিলেন। এই 'সিট'-এর তদন্তে বেশ কিছু তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ নেতা, সাংসদ এবং সেলিব্রিটিদের নাম উঠে এসেছিল।
২০১৮-র ১৮ অগাস্ট সিবিআই-এর তরফে পশ্চিমবঙ্গের ডিজি-কে চিঠি লিখে জানানো হয়, রাজীব কুমার সহ আরও কয়েকজন পুলিশ আধিকারিককে তারা এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। উত্তরে রাজ্য পুলিশের এক ডিআইজি সিবিআই-কে চিঠি লিখে জানান, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে সিবিআই এবং রাজ্য পুলিশের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের একটি বৈঠক করা যেতে পারে।
সিবিআই এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। আগাগোড়াই তাদের দাবি ছিল, রাজীব কুমার সহ তদন্তের প্রাথমিক পর্বে যুক্ত থাকা 'সিট'-এর অফিসারদের আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন, কারণ তাঁরাই সারদার অফিসে প্রথম ঢুকেছিলেন মামলা শুরু হওয়ার পর এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লোপাট করে দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অন্যদিকে, 'সিট'-এর অফিসাররা কলকাতা হাইকোর্টে পিটিশন দাখিল করে জানান, উদ্দেশ্যমূলক হয়রানির লক্ষ্যে তাঁদের নোটিস পাঠাচ্ছে সিবিআই। গত ডিসেম্বরের ৮ তারিখে ফের রাজীবকে নোটিস পাঠিয়ে সিবিআই ১৮ ডিসেম্বর হাজিরা দিতে বলে। উত্তরে রাজ্যের ডিজি জানান, সিবিআই কী জানতে চায়, আগে তার প্রশ্নমালা পাঠাক, তারপর বৈঠকের দিনক্ষণের কথা ভাবা যাবে।
এর প্রায় দেড় মাস পরে, ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয় গত রবিবার সন্ধেয়, যখন সিবিআই অফিসারদের একটি দল 'সিক্রেট অপারেশন'-এর নামে একটি হানা দেয় লাউডন স্ট্রিটে রাজীব কুমারের সরকারি বাসভবনে। সিবিআই অফিসারদের আটকে দিয়ে শেক্সপিয়ার সরণি থানায় নিয়ে যায় কলকাতা পুলিশের বাহিনী। পরে অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, সিবিআই এই মামলায় ছয়টি চার্জশিট দাখিল করেছে, যাতে কুণাল ঘোষ, মদন মিত্র এবং সৃঞ্জয় বসুর নাম রয়েছে।